তারেককে ফেরাতে নতুন তৎপরতা

>
তারেক রহমান
তারেক রহমান
• লন্ডনে সচিব পর্যায়ে সংলাপ
• পারস্পরিক আইনি সহায়তা ও আসামি প্রত্যর্পণের বিষয়ে সহযোগিতায় সম্মত হয়েছে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যকে নতুন করে চিঠি লিখছে বাংলাদেশ। লন্ডনে গত বৃহস্পতিবার দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের নেতৃত্বে কৌশলগত সংলাপে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে দুই দেশ পারস্পরিক আইনি সহায়তা ও আসামি প্রত্যর্পণের অনুরোধের বিষয়ে রাজি হয়েছে।

ঢাকা ও লন্ডনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল শুক্রবার বিকেলে প্রথম আলোকে জানায়, বাংলাদেশে অপরাধ করে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তদন্তসহ নানা রকম আইনি প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য আবারও অঙ্গীকার করেছে। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক আইনি সহায়তা ও আসামি প্রত্যর্পণের অনুরোধ রাখার মাধ্যমে সহযোগিতা বাড়াতে হবে।

তারেক রহমানকে ফেরানোর ব্যাপারে যুক্তরাজ্যকে অনুরোধ জানানোর বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক ৯ মার্চ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, গত মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনের আলোচনায় তারেক রহমানকে দেশে ফেরানোর প্রসঙ্গটি উঠেছিল। তখন বরিস জনসন ২০০৩ সালের আসামি প্রত্যর্পণ আইনের আওতায় নতুন করে চিঠি লেখার পরামর্শ দেন। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে এ বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। শিগগিরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এ চিঠি পাঠাবেন।

এর আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে একাধিক মামলার পলাতক আসামি তারেক রহমানকে বিচারের জন্য দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে যুক্তরাজ্যের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ডকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী। তবে যুক্তরাজ্য ওই চিঠির কোনো জবাব দেয়নি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আসামি প্রত্যর্পণ আইনের আলোকে নতুন করে চিঠি লিখলেও তারেক রহমানকে ফেরানোতে বেশ জটিলতা রয়েছে। প্রথমত এখন পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে আসামি প্রত্যর্পণের কোনো চুক্তি নেই। এখন পর্যন্ত দুই দেশ সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি ধরে একে অন্যকে সহযোগিতা করে। আসামি প্রত্যর্পণ আইন অনুযায়ী কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক শর্ত মানতে হয় যুক্তরাজ্যকে। এ ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তাঁর দেশে পাঠানোর ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যুক্তরাজ্যের আদালত।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, আসামি প্রত্যর্পণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ভারতের আদলে পারস্পরিক আইনি সহযোগিতা চুক্তি (এমএলএটি) সই করার কথা বিবেচনা করছে বাংলাদেশ। লন্ডনে কৌশলগত সংলাপে বিষয়টি তুলেছে বাংলাদেশ।

তারেক রহমান লন্ডনে কীভাবে অবস্থান করছেন, তিনি সেখানকার নাগরিকত্বের আবেদন করেছেন কি না জানতে সম্প্রতি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাইকমিশনে যোগাযোগ করা হয়। তারেক রহমানের অবস্থান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি যুক্তরাজ্য হাইকমিশন। ৮ মার্চ এক ই-মেইলে হাইকমিশনের গণমাধ্যম শাখা থেকে এই প্রতিবেদককে বলা হয়, কারও ব্যক্তিগত অভিবাসনের বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকার কোনো মন্তব্য করে না। তবে যুক্তরাজ্যের ২০০৩ সালের প্রত্যর্পণ আইনের আলোকে বাংলাদেশ (তাঁকে) ফেরত নেওয়ার বিষয়ে অনুরোধ করলে সেটি বিবেচনা করে দেখা হবে।

৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তারেক রহমানকে যুক্তরাজ্য থেকে ফেরানোর বিষয়টি আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে। ওই মামলায় তারেক রহমানসহ পাঁচ আসামিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই মামলায় তাঁর মা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। তিনি এখন কারাগারে আছেন।

এর আগে অর্থ পাচারের মামলায় ২০১৬ সালের জুলাইতে তারেক রহমানের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। এ ছাড়া ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলা মামলায়ও তারেক রহমান আসামি। ওই মামলার বিচারকাজ অনেকটা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে পলাতক থাকায় তারেক রহমানের বক্তৃতা-বিবৃতি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করে হাইকোর্ট ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি আদেশ দেন।

বড় বাধা প্রত্যর্পণ চুক্তি
এ মুহূর্তে আসামি প্রত্যর্পণের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই বাংলাদেশের। তবে যুক্তরাজ্যের আসামি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০৩-এ বলা আছে, কোনো দেশ তার অভিযুক্ত আসামিদের ফিরিয়ে নিতে পারে। তার মানে ওই আইনের আলোকে আসামিকে ফেরানো যাবে। এটি বিবেচনায় নিয়ে এখন যুক্তরাজ্যকে এমএলএটি সই করার প্রস্তাব দেওয়ার কথা ভাবছে বাংলাদেশ।

যুক্তরাজ্যের আসামি প্রত্যর্পণ আইনে বলা হয়েছে, আসামি ফেরত আনতে দূতাবাস কিংবা সরকারের বিশেষ প্রতিনিধির মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, সাজাপ্রাপ্ত হলে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি এবং আদালতের নির্দেশের বিস্তারিত জমা দিতে হয়। সেই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে প্রত্যর্পণের পর ওই ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি ছাড়া অন্য মামলায় তাঁকে সাজা দেওয়া হবে না। আত্মপক্ষ সমর্থনের সর্বোচ্চ সুযোগ থাকবে অভিযুক্ত ব্যক্তির।

এ শর্তগুলো পূরণের পর ওই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবেদন আমলে নেবেন। তারপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারে দেশটির আদালতের অনুমোদন চাইবেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যুক্তরাজ্যের আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন।

একটি প্রাথমিক শুনানির পর আদালত পূর্ণাঙ্গ শুনানির (প্রত্যর্পণ-বিষয়ক শুনানি) দিন ধার্য করেন। দায়ের করা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ‘আসামি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০৩’ এবং ‘ইউরোপীয় মানবাধিকার আইন, ১৯৯৮’ বিবেচনায় নিয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেন। এ সিদ্ধান্ত আসামির বিপক্ষে গেলে তিনি উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ পান। যুক্তরাজ্যের হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট বাদ দিয়ে তিনি ইউরোপের মানবাধিকার আদালতেও আপিল করতে পারবেন। এ বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো নির্দিস্ট সময়সীমা নেই। ফলে যুক্তরাজ্য সরকার চাইলেই কাউকে প্রত্যর্পণ করতে পারে না। এ বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত।

যুক্তরাজ্যে কোন মর্যাদায় আছেন
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পটভূমিতে ২০০৮ সালে চিকিৎসার জন্য আদালতের অনুমতি নিয়ে যুক্তরাজ্যে যান তারেক রহমান। ধারণা করা হয়, তিনি ‘ভ্রমণ ভিসায়’ গেছেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যে সাধারণত ‘ভ্রমণ ভিসার’ মেয়াদ থাকে ছয় মাস। তারেক রহমান ৯ বছরের বেশি সময় ধরে লন্ডনে থাকছেন।

ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, এতটা দীর্ঘ সময় তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে কোন মর্যাদায় আছেন, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য এখনো পায়নি। তবে বিএনপি-সংশ্লিষ্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র বলছে, তারেক রহমান রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন।

যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে অভিবাসন নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা আছে, এমন আইনজ্ঞদের মতে, তারেক রহমানকে দেশে ফেরানোর ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন প্রস্তাবে দুটি দিক আছে। প্রথমত, অনুরোধটি যুক্তরাজ্যের প্রত্যর্পণ আইনের আলোকে হতে হবে। সেটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় হওয়ার পর যুক্তরাজ্য সরকার সেটি তাদের আদালতে উপস্থাপন করবে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যর্পণের বিষয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি ইউরোপের মানবাধিকার আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।