ত্রিভুবনের কষ্ট

উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে শোক প্রকাশ। ছবি: এএফপি
উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে শোক প্রকাশ। ছবি: এএফপি

কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজের চতুর্থ তলার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ঢোকার মুখে নোটিশের মতো করে হাতে লেখা চারটি নাম। দুজন বাংলাদেশি, দুজন নেপালি। নামগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে একটু দেখতেই এক মধ্যবয়সী নারী এগিয়ে আসেন, জানতে চাইলেন আমি এঁদের কেউ কি না।

বাংলাদেশি সাংবাদিক পরিচয় দিলে তিনি কিছুটা নিরাশ হলেন। জানালেন, তিনি আসলে এঁদের কারও স্বজনকে খুঁজছেন। এই চারজনের একজন প্রিন্সি ধামি তাঁর মেয়ে। তাঁর অবস্থাও ভালো নয়। তাঁর মতো একজন বাংলাদেশি আছেন ইমরানা কবির। হয়তো তাঁর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে মন হালকা করতেন।

নেপালি নারী বললেন, ‘দেখো, আমার মেয়েটা রাগিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষে পড়ত। তার ইচ্ছা ছিল বিদেশে পড়ে দেশের জন্য কাজ করা। এখন সবই গেল। ডাক্তার বলেছেন সে হয়তো বাঁচবে না। বুকে পাথরচাপা দিয়ে আমরা বসে আছি। আমার মনে হয়, বাংলাদেশি এই মেয়েটারও একই দশা।’

বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ থেকে বের হচ্ছিল কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী
বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ থেকে বের হচ্ছিল কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী

আমি এই নারীর মুখের দিকে তাকাতে পারি না। তাঁর হাতের টিস্যু পেপার ভিজে জবজবে। তবু তিনি চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করছেন। আইসিইউর অপেক্ষা কক্ষের চেয়ারগুলো মানুষে ঠাসা। একজন ভিনদেশি লোকের সামনে এভাবে এই নারীকে কাঁদতে দেখে সবাই তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন। এক বালক এসে নারীর হাত ধরে। আমি তাঁকে চেয়ারে বসতে অনুরোধ করি।

নেপালি নারীর মেয়ের পাশেই আছেন ইমরানা কবির। তাঁর  অবস্থা গুরুতর। শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। ইমরানার  স্বামী রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রকিবুল হাসান ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। আশরাফ উদ্দিন নামে এক স্বজন ইমরানার চিকিৎসার খোঁজখবর করছেন। তিনি বললেন, ‘জানি না কী হবে। হয়তো সে বাঁচবে না, তাই বলে চেষ্টা তো আর কম করা যাবে না।’

তালিকায় থাকা বাংলাদেশি আহত যুবক মেহেদী হাসানের খোঁজ করতে ভেতরে ঢুকি। গাজীপুরের মেহেদী হাসান—তাঁর বেঁচে ফেরার গল্প শুনতে হবে।

১২ মার্চ কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস-বাংলার বিমানে (বিএস ২১১) ছিলেন মেহেদী ও তাঁর পরিবারের চার সদস্য। বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা মেহেদীর স্ত্রী কামরুন নাহার স্বর্ণা, সঙ্গে ভাইয়ের স্ত্রী আলমুন নাহার অ্যানি, ভাই তরুণ আলোকচিত্রী প্রিয়ক হাসান ও তাঁদের এক শিশুসন্তান। সবাই এসেছিলেন কাঠমান্ডুতে বেড়াতে। অনেক দিনের শখ। মেহেদী বললেন, ‘সবকিছু ভালোই চলছিল। বিমানও নেমে যাচ্ছে। আমরা সিটবেল্ট বেঁধে অপেক্ষায় আছি। বিমানটি নামতে গিয়ে হঠাৎ কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেল। একবার নয়, দুবার। এরপর বিকট আওয়াজ। আমরা ছিলাম বিমানের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। দেখলাম পেছনের দিক থেকে আগুন আসছে। জানালা ভাঙার চেষ্টা করলাম। হলো না। মুহূর্তেই বিমানটি মাঝবরাবর ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেল। আমি নিচে লাফিয়ে পড়লাম। আমার স্ত্রীকে নামালাম। এরপর ভাইয়ের স্ত্রীকে। ভাই আর তাঁর বাচ্চাকে আর নামাতে পারিনি। এর আগেই সব আগুন ধরে যায়।’

মেহেদী বলে চলেন, ‘বিমানের আসনগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে এমনভাবে লেপ্টে গেল যে কেউ আর নামতে পারলেন না। আসনের ফাঁকে আটকা পড়ে গেলেন। এক থেকে দুই মিনিটের  মধ্যে পুরো বিমানটিতে আগুন ধরে গেল। কেউ আর নামতে পারলেন না। ভাই প্রিয়ক হাসানকে আর বাঁচানো গেল না।’ প্রিয়কের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মেহেদী।

মেহেদীর পাশে আছেন ভাইয়ের স্ত্রী আলমুন নাহার। একমাত্র সন্তান তামারাকে হারিয়ে তিনি কেঁদেই চলেছেন। তাঁর কান্না আর থামছে না।

ইউএস-বাংলার বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ। ছবি: এএফপি
ইউএস-বাংলার বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ। ছবি: এএফপি

কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস–বাংলার ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় চারজন ক্রুসহ বিমানের ৭১ জনের সবাই হতাহত হন। তাঁদের মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশি, ২৪ জন নেপালি এবং ১ জন চীনা নিহত হন। আর ১০ জন বাংলাদেশি, ৯ জন নেপালি ও ১ জন মালদ্বীপের নাগরিক আহত হন।

দুর্ঘটনার খবর সংগ্রহ করতে গণমাধ্যমকর্মীরা ছুটে আসেন কাঠমান্ডুতে। আমরা ছুটছি এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসাপাতালে। কখনো মেডিকেল কলেজ, কখনো ওম হাসপাতাল। আহত মানুষ বা তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলি। কারও গল্প কম নয়। ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে কীভাবে ফিরে এসেছেন, সেই গল্প। মানুষ কীভাবে বেঁচে ফিরে আসে, সেই গল্প। 

কাঠমান্ডু টিচিং হাসপাতালের মর্গে রাখা হয় ৫১টি মৃতদেহ। সেখানেও স্বজনদের ভিড়। কীভাবে মৃতদেহ নিয়ে যাবেন, তাই নিয়ে চিন্তা। ইউএস-বাংলার কাঠমান্ডু অফিসে কাজ করতেন হরিশঙ্কর পাওয়াল। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় তিনি মারা গেছেন। তাঁর ভাই হরিচরণ পাওয়াল মর্গের সামনে বসে আছেন প্ল্যাকার্ড হাতে। ভাইয়ের মৃতদেহ তিনি নিয়ে যেতে চান। বাংলাদেশের রানার অটোমোবাইলের কাস্টমার কেয়ারের প্রধান মাহমদুর রহমান, আরেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও নুরুজ্জামান বাবুর মৃতদেহ নিতে এসেছেন রানারের কর্মকর্তা সৌরভ আহমেদ। মর্গের সামনে মন খারাপ করে তিনি বসে আছেন।

হাসপাতালের দরজায় সাঁটানো চিরকুট
হাসপাতালের দরজায় সাঁটানো চিরকুট

উড়োজাহাজটির কো-পাইলট পৃথুলা রশীদের নানা এম এ মান্নান দুই দিন ধরে কাঠমান্ডুতে। তিনিও আছেন মৃতদেহের অপেক্ষায়। নিহত উম্মে সালমার স্বামী ঢাকায় ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর কর্মকর্তা মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু চোখের জল ফেলছেন।

সিলেটের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেলের নেপালি ছাত্রী সোয়েতা থাপার মা উর্মিলা প্রধানের দিকে কেউ তাকাতে পারছেন না। মেয়ের ছবি হাতে ধরে মর্গের সামনে বসে আছেন। চোখের জল সামলে তিনি যা বললেন তা এমন—উড়োজাহাজটি যখন নামে, তখন তিনি বিমানবন্দরে। দেখছেন বিমান নামছে, মেয়ে নেমে আসবে। হঠাৎ দেখেন বিমানে আগুন। ‘চোখের সামনে দেখলাম পুরো বিমানটি জ্বলছে।’ বললেন উর্মিলা প্রধান।

এই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত একমাত্র চীনা নাগরিকের এক সহকর্মীও মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কারও প্রতীক্ষা যেন শেষ হয় না। কেউ প্রতীক্ষা করে আছেন মৃত মানুষের, কেউ জীবিতের। সবাই অপেক্ষায় একসঙ্গে, এক কাতারে।

আমরা যাঁরা সংবাদ সংগ্রহে এসেছি, তাঁরা কারও মুখের দিকে তাকাতে পারি না। সবার চোখ ছলছল। নিজের কাছেই খারাপ লাগে। যাঁরা এসেছেন, কেউ কথা শেষ করতে পারেন না। তার আগেই চোখের পানি মুছতে হয়। অনেক সময় কথা বলতে আর ইচ্ছা করে না। তবু কথা বলি আমরা। এটাই কাজ আমাদের।

কো-পাইলট পৃথুলা রশীদের নানা এম এ মান্নান
কো-পাইলট পৃথুলা রশীদের নানা এম এ মান্নান

ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু আসার দিনের কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন সাত সকালে বিমানবন্দরে এসে দেখি ডিপারচার লাউঞ্জের ভেতরে জনা পঞ্চাশেক মানুষ ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছেন। আর বিমানবন্দরের সব মানুষের চোখ যেন সেদিকে। তাঁদের ঘিরে রীতিমতো জটলা হচ্ছে। অপেক্ষমাণ মানুষের কারও মুখে হাসি নেই, কেউ কাঁদছেন, কেউ মন খারাপ করে বসে আছেন। একজন অন্যজনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

এক গণমাধ্যমকর্মী বললেন, ‘এঁরা কাঠমান্ডুর ভিকটিমদের স্বজন। চলেন কথা বলি। দুজনে এগিয়ে যাই। বিমানবন্দরে ঢোকার সময় প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক সাজিদ হোসেন বলেছিলেন, আমি যেন ভেতর থেকে স্বজনদের ছবি পাঠাই। কিন্তু এসব মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার আর ছবি তুলতে ইচ্ছা করেনি।

স্বজনের খোঁজে। ছবি: প্রথম আলো
স্বজনের খোঁজে। ছবি: প্রথম আলো

কাঠমান্ডু এসে দেখি সেই একই অবস্থা।  এখানেও সেই মানুষগুলো কাঁদছেন। তবু তাঁদের সঙ্গে কথা বলি, ছবি তুলি। ইচ্ছা না করলেও প্রশ্ন করি। আমি একা নই, দেশি-বিদেশি অনেক সংবাদকর্মী। সবাই আছেন খবর সংগ্রহের নেশায়। সেই খবর ছাপা হবে, প্রকাশিত হবে, মানুষ জানবে, কখনো জনমত তৈরি হবে। কিন্তু যাঁর সব হারাল, তাঁর কী হবে? সন্তানের জন্য দিনরাত হাসপাতালের বিছানায় বসে কাঁদা গাজীপুরের সেই আলমুন নাহার কি ফিরে পাবেন কোলের ছোট সন্তানকে, যাকে চোখের সামনে আগুনে পুড়ে মরতে দেখেছেন তিনি! তাঁর চোখের পানি কি কখনো শুকাবে?