সুন্দরবনে গোলাপি ডলফিন

গোলাপি ডলফিন। ১০ মার্চ সুন্দরবনের মালঞ্চ নদী।  ছবি: মনিরুল এইচ খান
গোলাপি ডলফিন। ১০ মার্চ সুন্দরবনের মালঞ্চ নদী। ছবি: মনিরুল এইচ খান

কেউ বলে ডানাকাটা পরি, কেউ সাগরের রাজকন্যা। সাধারণ নাম গোলাপি ডলফিন। বঙ্গোপসাগরে ও মোহনায় কালেভদ্রে এদের দেখা মেলে। গেল সপ্তাহে বন বিভাগ ও বন্য প্রাণী গবেষকদের একটি দল সুন্দরবনের পশ্চিম অংশে অপূর্ব সুন্দর ওই প্রাণীর দেখা পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু চরের পাশে পুটনি দ্বীপের কাছে চারটি গোলাপি ডলফিনকে দল বেঁধে সাঁতার কাটতে দেখা গেছে।

২০০২ সালে প্রথমবারের মতো ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির একটি জরিপে বাংলাদেশে গোলাপি ডলফিনের অস্তিত্বের কথা জানানো হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালে এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটিকে বঙ্গোপসাগরে দেখা যায়। কিন্তু সুন্দরবনের সীমানায় এই প্রথমবারের মতো এদের দেখা গেল। পৃথিবীজুড়ে গোলাপি ডলফিনকে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে মনে করা হয়।

ব্যতিক্রমী গায়ের রং ছাড়া এই ডলফিনের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এর আকৃতি ও ওজন। পৃথিবীতে যে আট প্রজাতির ডলফিন আছে তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় ও বিরল। সাধারণত বেশি লবণাক্ত পানিতে এরা বিচরণ করে। দূষণ ও নৌযানের যাতায়াত যেখানে বেশি, সেখানে তারা থাকতে পছন্দ করে না। ফলে বঙ্গোপসাগরের অতল অংশ ও মোহনায় এদের মাঝেমধ্যে দেখা যায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খানের নেতৃত্বে একদল বন্য প্রাণী গবেষক গত সপ্তাহে গিয়েছিলেন সুন্দরবনে। তাঁরা সারা দেশে ডলফিনের বসতি এলাকা ও সংখ্যা নির্ধারণে একটি জরিপ করছেন। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ও বন বিভাগ ওই জরিপ করছে। দেশের কোথায় কোথায় ডলফিনের বসতি এলাকা ও বসবাসের পরিবেশ রয়েছে, তা বুঝতে জরিপটি করা হচ্ছে।

অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের পুটনি দ্বীপটি বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনের মোহনায় অবস্থিত। সেখানে পানির লবণাক্ততা বেশি। এটি গোলাপি ডলফিনের (ইন্দো প্যাসিফিক হাম্পব্যাক) বসবাসের জন্য উপযুক্ত জায়গা। ফলে সেখানে এদের বড় বসতি থাকতে পারে। ওই স্থানটিকেও ডলফিনের জন্য নিরাপদ এলাকা বা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে।

আকার–আকৃতিতে এরা অন্য সাত প্রজাতির ডলফিনের চেয়ে বড়। এরা ঘাড় ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত বাঁকাতে পারে। এরা ধনুকের মতো শরীর বাঁকাতে পারে। লম্বায় এরা ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত হয়। ওজন গড়ে ২০০ পাউন্ড বা ৯০ কেজির বেশি। তবে জন্মের পর বাচ্চা ডলফিনের ওজন হয় মাত্র ১ কেজি আর লম্বায় থাকে ৩০ ইঞ্চি।

মাছই গোলাপি ডলফিনের প্রধান খাবার। কারেন্ট জাল ব্যবহারের কারণে গোলাপি ডলফিনের মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে। আমাজনের লোকজন এ ডলফিনকে খুবই পবিত্র বলে বিশ্বাস করে। তারা কখনো গোলাপি ডলফিন মারে না। তারা মনে করে, গোলাপি ডলফিনের চোখে চোখ রেখে তাকালে সারা জীবন দুঃস্বপ্ন দেখতে হবে। তাই তারা ভুলেও কখনো কোনো গোলাপি ডলফিনের চোখের দিকে সরাসরি তাকায় না।

এ ব্যাপারে বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়ে গোলাপি ডলফিনের সংখ্যা কমে আসছে। এ পর্যন্ত চার-পাঁচবার এই ডলফিনের দেখা পাওয়া গেছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময় তা বঙ্গোপসাগরের মধ্যে। সুন্দরবনের ভেতরে এটি দেখতে পাওয়া গেলে তা অতি বিরল ঘটনা।

বিশ্বে গাঙ্গেয় শুশুক বা ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন, পাখনাহীন পয়পয়েস ডলফিন, থেবড়া দাঁত ডলফিন, বোতল নাক ডলফিন, চিত্রা ডলফিন, ঘূর্ণি ডলফিন ও গোলাপি ডলফিন নামে আটটি প্রজাতি রয়েছে। ২০০৪ সালে গোটা উপকূলীয় এলাকায় জরিপ করে ছয় হাজার ডলফিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ইরাবতী ডলফিন রয়েছে সুন্দরবনে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীর চারটি স্থানকে ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে।