গঠনতন্ত্র না মানার রীতিতেই ছাত্রলীগ

ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলনের সময়সীমা ঘোষণা করেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা করেন, মার্চে এই সম্মেলন হবে। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন গণমাধ্যমকে জানান, ৩১ মার্চ সম্মেলন হবে।

কিন্তু চলতি মাসের শুরুতে এসে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আবারও গণমাধ্যমকে বললেন, নির্ধারিত দিনে ছাত্রলীগের সম্মেলন হচ্ছে না। সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বলছেন, ৩১ মার্চ সম্মেলন করার কথা মুখে বললেও সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছিল না। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনের তারিখ পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়নি। একটি সাধারণ সভা ডেকে নিজেরাই শুধু বক্তব্য দিয়ে সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বলেন। কিন্তু রেওয়াজ অনুযায়ী, সম্মেলনের প্রস্তুতির জন্য কোনো উপকমিটি গঠন করে দেওয়া, সম্মেলনের স্থান ঠিক করা কিংবা অন্য কোনো ধরনের তৎপরতা ছিল না।

ছাত্রলীগের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, জানুয়ারির ওই ঘোষণার পর ৯ জানুয়ারি নওগাঁ ও মেহেরপুর জেলা, ২৮ জানুয়ারি শেরপুর ও পাবনা জেলা এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি, ১২ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৩ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলা উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলন হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা জেলার সম্মেলন হলেও কমিটি এখনো হয়নি। এগুলোর বেশির ভাগের সম্মেলনের তারিখ আগে থেকে নির্ধারিত ছিল। নতুন করে কোনো কমিটি করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

গঠনতন্ত্র না মানার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের সম্মেলন নিয়মিতই হয়, তবে পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক কারণে সময় একটু এদিক-সেদিক হতে পারে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে দ্রুতই সম্মেলন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

ছাত্রলীগের সম্মেলন ঘিরে যাঁরা প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশের অভিযোগ, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের আগে কীভাবে সম্মেলন ঠেকানো যায়, সে পরিকল্পনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তবে তাঁরাও নিজ নিজ জায়গা থেকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩১ মার্চ সম্মেলন হচ্ছে না। তবে সময়মতোই হবে। আমরা সম্মেলনের জন্য সব সময় প্রস্তুত।’ তবে তা কবে বা কখন, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

২০১৫ সালের ২৬ ও ২৭ জুলাই সম্মেলনে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি গঠিত হয়। ছাত্রলীগের গণতন্ত্রের ১১ এর খ ও গ ধারা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ দুই বছর। কিন্তু বর্তমান কমিটি আরও প্রায় আট মাস বেশি পার করেছে। এর মধ্যেও কোনো আলোচনা না দেখে ছাত্রলীগ নেতাদের একাংশ সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার আশ্বাসে তারা ওই সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করে। এরপরই ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ওবায়দুল কাদেরের ঘোষণা আসে।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যে মার্চে সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। তাঁরা নিজেরাও জানতেন না এমন কোনো ঘোষণা আসতে পারে। কারণ তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন, আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন আনা হবে না। ১৯৯২ সালের পর থেকে ছাত্রলীগের সবগুলো কমিটি অন্তত চার বছর করে দায়িত্ব পালন করেছে। ফলে এই মুহূর্তে সম্মেলনের বিষয়টি বর্তমান কমিটির ‘ব্যর্থতা’ হিসেবেই দেখা হবে।

ওবায়দুল কাদেরের ঘোষণার পর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে ৩১ মার্চ সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। পরে ১২ জানুয়ারি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভা আহ্বান করা হয়। সেখানে সবাইকে ছাত্রলীগের সম্মেলনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে দ্রুত সভা শেষ করা হয়। ওই সভায় শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই বক্তব্য দিয়েছিলেন। কয়েকজন নেতা বক্তব্য দিতে চাইলেও তাঁদের থামিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে চাঞ্চল্য ফিরে আসে। বিভিন্নভাবে তাঁরা পরবর্তী সম্মেলনে নিজেদের প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করে আসছিলেন। আগের কমিটিতে পদবঞ্চিত ও বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কৃত অনেক নেতাও নতুন করে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছিলেন। তবে এর মধ্যে বেশ কয়েকবারই সম্মেলন না হওয়ার গুঞ্জন ছড়ায়। কেউ কেউ ৩১ মার্চ সম্মেলন না হলে প্রার্থীদের দেখে নেওয়ার হুমকিও দেন। সভাপতি-সম্পাদককে ছাড়াই সম্মেলনের সফলতা কামনা করে মিছিল করে একটি অংশ।

এর মধ্যে ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের জনসভার রাতে ছাত্রলীগের একটি অংশ গুঞ্জন ছড়ায়, ৩১ মার্চই ছাত্রলীগকে সম্মেলন করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী। পরদিন ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে গণমাধ্যমকে জানান, নির্ধারিত ওই দিনে সম্মেলন হচ্ছে না। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে সম্মেলন-প্রত্যাশী দুই নেতাসহ তিনজন ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর হামলার শিকার হন।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্মেলন নিয়ে আমরা এই মুহূর্তে ভাবছি না। আমাদের সামনে অনেক কাজ। প্রাথমিক সদস্য নেওয়া হবে, জাতীয় নির্বাচনের প্রচারে কাজ শুরু করতে হবে।’ প্রস্তুতির ঘাটতির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ধরনের কথা যারা বলে তারা কেউ সংগঠনের ভালো চায় না।