'পলাতক' জহির হাজির

শিশু ধর্ষণ মামলার আসামির নামটা এজাহারেই ছিল। পুলিশ তাঁর ঢাকার ঠিকানাও পেয়েছিল। কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাচ্ছে না বলে পুলিশ তাঁর অব্যাহতি চায়। লোকে অবশ্য বলে তিনি নাগালের মধ্যেই ছিলেন।

ঘটনার শুরু ২০১৬ সালের এপ্রিলে। মেয়েটি তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ঘটনার আগের দিন ১১ এপ্রিল দুপুরে স্কুলে যাওয়া নিয়ে মা যখন তাকে বকাঝকা করছেন, সে সময় এলাকার একটি মেসবাড়ির ঠিকা ঝি শাহনাজ পারভীন তাদের বাসায় আসেন। মেয়েটিকে এক পাশে ডেকে বৈশাখী পোশাকের লোভ দেখিয়ে যান।

পরদিন মেয়েটি সকালে স্কুলে বেরোয় কিন্তু ফেরে না। মা-বাবা খোঁজাখুঁজি করেন, থানায় জানান। শাহনাজের কাছেও যান। কিন্তু মেয়ের হদিস নেই।

অনেক রাতে মেয়েটির এক সহপাঠী বলে, স্কুলে যাওয়ার পথে শাহনাজ মেয়েটিকে নতুন জামা দেবেন বলে মেসবাড়িতে ডেকে নিয়ে আটকে রেখেছেন। পরদিন অনেক চেষ্টার পর বিকেলে মা-বাবা আর প্রতিবেশীরা মিলে তাকে উদ্ধার করেন।

মেয়েটি বলে ওই মেসের একটি ঘরে গভীর রাতে একজন লোক এসে তাকে ধর্ষণ করেন। শাহনাজ তার হাত-পা-মুখ ওড়না দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন।

মেয়েটির বাবা ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করেন, মা ঠিকা ঝি। মায়ের এজাহারে ওই দিনই মতিঝিল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় ধর্ষণের মামলা রুজু হয়। ওপরের বিবরণ এজাহার আর হাকিমের কাছে দেওয়া মেয়েটির জবানবন্দি থেকে পাওয়া।

এজাহারে ধর্ষণের আসামি হিসেবে লোকটির নাম আছে ‘জহির’। কিন্তু তাঁর বাবার নাম বা ঠিকানা নেই। জহিরকে সহযোগিতার অভিযোগে শাহনাজ পারভীনকেও আসামি করেন মা।

তখন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুল কাদের। তিনি ওই দিনই জহিরের ঘর থেকে মেয়েটির জামা-পায়জামা ও একটি ওড়না জব্দ করেন। পরদিন মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা করান আর শাহনাজকে গ্রেপ্তার করেন।

এজাহারে ঘটনাস্থলের ঠিকানা ভুল ছিল। আইও সেটা নিয়মমাফিক সংশোধন করেন। তিনি সহযোগী আসামি শাহনাজ পারভীনকে গ্রেপ্তার করে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে জহিরের একটা স্থায়ী ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বর পান। ঘটনার পরদিনের ‘কেস ডায়েরি’তে সেটা তিনি টুকেও রাখেন।

কিন্তু চার মাস তদন্তের পর পুলিশ যাচাই করে বলে, সেই ঠিকানা সঠিক নয়। শাহনাজের স্থায়ী ঠিকানাও ভুল।

স্থায়ী ঠিকানা সঠিক না হলে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া যায় না। জহির তখনো ‘পলাতক’। মেয়েটির মা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশকে তিনি বলেছিলেন, জহির গুলিস্তানের একটি ক্লাবে লাইনম্যানের চাকরি করেন। অথচ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করল না। এখনো তিনি সেখানেই কাজ করেন।

মায়ের কথা, ‘আমরা গরিব বলে কি বিচার পাব না?’

ঢাকা মহানগর পুলিশের নারী সহায়তা ও তদন্ত বিভাগের উপপরিদর্শক বেগম রেহেনা আক্তার মামলার দ্বিতীয় আইও। ঘটনা সত্য, আসামিদের স্থায়ী ঠিকানা পাওয়া গেলে তদন্ত আবার চালু করা যাবে—এ কথা বলে তিনি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে আসামিদের অব্যাহতি চান। আর গত বছরের ১৬ আগস্ট ঢাকার ১ নম্বর নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল সেটি গ্রহণ করেন।

এই প্রতিবেদক গত অক্টোবরে মেয়েটির বাসায় যান। তার মা তখন কাজ করে ঘরে ফিরেছেন। বাবাও ঘরে ছিলেন। মা বলেন, চূড়ান্ত প্রতিবেদনের শুনানিতে হাজির থাকার জন্য আদালতের কোনো কাগজ তাঁরা পাননি। আর জহির তাঁদের চোখের সামনে অহরহই ঘুরে বেড়ান।

তাঁরা প্রতিবেদককে যুবলীগের স্থানীয় একটি কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে এক নেতা বলেন, জহির এখনো এই এলাকায় থাকেন। তিন দিন পর ওই মেসবাড়িতে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জহির এখন আর সেখানে থাকেন না। ঘটনার পর থেকে এদিকে আসেনও না। তিনি গুলিস্তানে থাকেন।

এই সূত্র ধরে সন্ধ্যায় গুলিস্তানের একটি ক্লাবের সামনে গেলে উপস্থিত একজন আনসার সদস্য বলেন, জহির ওই ক্লাবের জুয়ার আখড়ার ‘লাইনম্যান’। তাঁর একটি ফোন নম্বরও জোগাড় করা যায়।

সেখান থেকে ফিরে মামলার প্রথম আইও এসআই কাদেরকে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘আমি জহিরকে গ্রেপ্তার করার জন্য তিনি যেখানে থাকতেন সেখানে গিয়েছি, গুলিস্তানে যে ক্লাবে চাকরি করতেন, সেখানে গিয়েছি। কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাইনি।’ দ্বিতীয় আইও বেগম রেহেনা আক্তারও একই কথা বলেন।

অথচ অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে প্রথম আলোর অনুসন্ধানী দলের সদস্যরা জহিরকে ফোনে পান। জহির বলেন, তিনি ক্লাবে চাকরি করেন। প্রায় দুই বছর আগে তিনি ওই মেসে থাকতেন।

জহির বলেন, ‘মামলা হইসিল আর কি। এইটা আমি সঠিক জানি না আর কি।...আমি কিসু জানি না।’ খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘রুমডা আমার নামে ছিল। রুম হিসাবে আমার নামে (মামলা) করসিল। রুমের ভিতরে কিছু হইসে না, একটা ফলস মামলা করসে।’

প্রশ্নের মুখে একসময় জহির বলেন, ‘অহন আমি দেশে আছি তো; ঢাকা নাই।’ তারপর তিনি ফোনটা কেটে দেন।