৯৭ জন খুঁজছে যাঁকে, তিনি আছেন মুন্সিগঞ্জে

নজরুল ইসলাম নজু
নজরুল ইসলাম নজু
>
  • নজু সর্দার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী।
  • নজুর ব্যবসা মিরপুরের চলন্তিকা ও ঝিলপাড় এলাকায়।
  • নজুকে ধরতে ৯৭ জনের একটি দল কাজ করছে।
  • কখনো গ্রেপ্তার হননি নজু।

নজু সর্দারসহ ঢাকার শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও পুলিশের ৯৭ জনের দল ঢাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। আর নজু মুন্সিগঞ্জের ‘জান্নাতুল ভিলা’য় বসে তাঁর ‘মাদক সাম্রাজ্যের’ খোঁজখবর রাখছেন। আজ পর্যন্ত কখনো নজু গ্রেপ্তার হননি, তিনি এসবে খুব একটা পাত্তা-টাত্তাও দেন না বলে কথিত আছে।

ঢাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে যখন থেকে মাদকের কেনাবেচা শুরু, তখন থেকেই নজুর নাম বিক্রেতাদের তালিকার প্রথম পাঁচজনের মধ্যে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশকে হাতে রেখে তিনি মিরপুরের চলন্তিকা ও ঝিলপাড় এলাকায় আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে মাদক বিক্রি করে আসছেন। ঢাকার রূপনগর থানা সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে চলন্তিকা বস্তিতে নজুসহ মাদক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ৮৩টি মামলা করেছে। গত ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ স্থানীয় সাংসদকে নিয়ে নজুর ডেরায় অভিযানও চালায়।

প্রশ্ন উঠেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি সত্যিই নজু সর্দারকে ধরতে চায়? মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ খোরশিদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ৭৮ জন, এপিবিএনের ৯ জন ও পুলিশের ১০ জনকে নিয়ে গত ১১ মার্চও অভিযান হয়েছে। নজুর খোঁজে চলন্তিকাতেও গেছেন বাহিনীর লোকজন। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নজু সর্দার ওরফে নজরুল কাজী ওরফে নজু কাজী মিরপুরের চলন্তিকায় এখন খুব একটা যান না। তিনি মুন্সিগঞ্জেই থাকেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলে বড়জোর বরিশালে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। গেল সপ্তাহ থেকে তিনি মুন্সিগঞ্জেই থাকছেন। শহরের সবচেয়ে দামি জায়গা মানিকপুরে তাঁর ছয়তলা ভবন জান্নাতুল ভিলা। কখনো সেখানে, কখনো-বা মধ্য কেওরে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। গ্রামের বাড়ির চারতলা ভবনের কাজ তিনি প্রায় শেষ করে এনেছেন, টাইলস বসানোর কাজ চলছে এখন। পুরোদমে চলছে আল নাহিয়ান বাইতুন নুর জামে মসজিদ তৈরির কাজ। জানা গেছে, শুধু মুন্সিগঞ্জেই কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক তিনি। বরিশালেও তাঁর বেশ কিছু সহায়সম্পত্তি আছে। পরিবারটির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, নজু এখন নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে আরেকটি ডেরা তৈরির চেষ্টা করছেন। তবে মাদক বিক্রির কাজটা মিরপুরের চলন্তিকা বস্তির ২৫টি ঘর থেকেই তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। গোটা পরিবার এই কাজে তাঁকে সাহায্য করে।

গত ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি মিরপুরের চলন্তিকায় স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ টানা অভিযান চালায়। ওই অভিযানের সময় একটি ঘর থেকে স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস মোল্লা নজু সর্দারের মা সুফিয়া বেগমকে বের করেন। দুটি রামদাসহ গ্রেপ্তার হন নজু সর্দারের ভাগনে রিয়াজ। অভিযোগ আছে, নজুর মা সুফিয়া খাতুন, দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা ও শাশুড়ি ফেলানি চলন্তিকায় মাদক কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁদের সহযোগিতা করেন নজুর বোন শান্তি ও লীলা। বিভিন্ন স্পটে কবে কে থাকবেন, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সামাল দেবে কে, সেসবও ঠিক করেন তাঁরা। ২০১৬ সালে র‍্যাব-৪ নজু সর্দারকে ধরতে ওই বস্তিতে যখন অভিযান চালায়, তখন এই নারীরাই বস্তির ভেতর বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করেন ও নজুকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। জানা গেছে, তোফা ও বাবুল সর্দার কারওয়ান বাজারে গাঁজা বিক্রি দিয়ে মাদকের বেচাকেনায় যোগ দেন। মিরপুরে এই কাজে যুক্ত হন নজু সর্দার। তোফা কাজী মুন্সিগঞ্জের সিবাইপাড়া, শাঁখারিপট্টিতে একটি মাদকের আড্ডা চালান। সেখান থেকে মাস তিনেক আগে তোফা সর্দারের ছেলে পরানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বাবুল সর্দার এখনো মিরপুরে মাদকের কেনাবেচায় জড়িত। বাবুল সর্দারের ছেলে রাসেল কাজী, নজুর বোন রানীর তিন ছেলে রাজন, রিফাত ও রিয়াজ, নজুর মেয়ে-জামাই শান্ত সম্পদের হিসাব-নিকাশ রাখেন।

নজু সর্দারের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বইন, সবই আপনার জানা। ছোট ভাইটার দিকে তাকায়া একটু রহম করেন।’ কেন ‘রহম’ চান জানতে চাইলে তিনি আবারও বলেন, সবারই সবকিছু জানা। মাদক বিক্রি কেন করেন এমন প্রশ্নে বলেন, তাঁর নামে অন্যরা এসব করে। তিনি নির্দোষ।

নজু সর্দারের উত্থান
গত সপ্তাহের শনিবার মধ্য কেওরে নজু সর্দারদের গ্রামের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা হয়। জানা গেল, নজু সর্দারের বাবা আবদুল আলী কাজী কৃষিকাজ করতেন। তিন ছেলে, পাঁচ মেয়ে নিয়ে তাঁর কায়ক্লেশে জীবন কাটছিল। দারিদ্র্য ঘোচাতে একপর্যায়ে বড় ছেলে তোফাজ্জল কাজী ওরফে তোফা কাজী ওরফে তোফা সর্দার ও মেজ ছেলে বাবুল কাজী ওরফে বাবুল সর্দার ঢাকায় চলে আসেন। তাঁরা রাজধানীর কারওয়ান বাজারে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তুলতেন। নজু সর্দার তেমন কিছু করতেন না। পরিবারটির শিক্ষাদীক্ষাও কম। আবদুল আলী কাজীর ঘনিষ্ঠ একজন আত্মীয় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওদের ধারেকাছে থাকলে মানুষ হব না, আব্বা-আম্মা এই ভয় করত। তাই বসতভিটা ছেড়ে খেতের মধ্যে আব্বা জমি কিনেছিল। কোনো রকমে একটা ঘর তুলেই আমরা ভিটা ছেড়ে চলে আসি।’ ভয়টা কিসের জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিরপুরের চলন্তিকায় ওরা ‘কী কী’ করে বলে তাঁরা শুনেছেন।
মধ্য কেওরে বাড়ি তুললেও গ্রামের লোকজনের সঙ্গে তাঁদের তেমন একটা যোগাযোগ নেই। আলাউদ্দীন মিয়া নামে গ্রামের এক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, বছরে একবার ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার নজু সর্দারের মা সুফিয়া বেগম গ্রামের লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়ান। তিনি কলার ভেলা সাজিয়ে ভেতরে খাবারদাবার, আগরবাতি, মোমবাতি জ্বেলে পানিতে ভাসান। গান-বাজনারও আয়োজন করেন। প্রতিবছরই এই আয়োজনের জাঁকজমক বাড়ছে। ওই সময় ছাড়াও কাজীবাড়ির লোকজনকে দল বেঁধে মাঝেমধ্যে মধ্য কেওরের বাড়িতে আসতে দেখা যায়।

গ্রামের বাড়ির আত্মীয়স্বজনের পুলিশ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ। শহরের মানিকপুরের ছয়তলা ভবনের নিচতলায় একটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানো আছে। ভবনের আশপাশে কাউকে দেখা গেলেই পরিবারের লোকজন সতর্ক হয়ে যান। শনিবার ওই ভবনের ছবি তোলার সময় হঠাৎ একটি মোটরসাইকেলে করে এসে হাজির হন নজু সর্দারের ভাই বাবুল সর্দারের ছেলে রাসেল কাজী। এসেই জেরা করতে শুরু করেন। পরে প্রথম আলোর স্থানীয় প্রতিনিধির বাসায় গিয়েও হাজির হন তিনি।

মুন্সিগঞ্জে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজিজুল হক জানান, মাদক বিক্রেতাদের ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে তাঁরা তথ্য পান। নজু সর্দার সম্বন্ধে কিছু জানেন না। আর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন কেবল বললেন, পুলিশ কাজ করছে। নিয়মিত অভিযান ও গ্রেপ্তার চলছে।
তারপরেও নজু সর্দার কেন সবার চোখের আড়ালে রয়ে গেলেন, সেই প্রশ্নের জবাব আর পাওয়া যাচ্ছে না।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের কাছে মাদক বিক্রেতাদের তালিকা আছে এবং নিয়মিত এই তালিকা হালনাগাদ করা হয়। এমন একজন মাদক বিক্রেতা এভাবে সহায়-সম্পত্তি করছেন, সেটা পুলিশ জানবে না—এটা একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে, যাঁরা মাদক নিয়ে কথা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে কর্তৃপক্ষ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। জিরো টলারেন্সের কথা শোনা যাচ্ছে, এর সঙ্গে মানুষ কিছু কাজও দেখতে চায়। নইলে পুলিশের ভাবমূর্তির যে প্রশ্ন, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।