ভারতের পরামর্শক সেবা নিতে চুক্তির খসড়া মন্ত্রিসভায়

>
  • ভারতের যুক্ততার বিষয়ে ১ মার্চ এমওইউ সই হয়েছে।
  • পাবনার রূপপুরে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
  • গত অক্টোবরে প্রকল্পটির মূল নির্মাণপর্ব শুরু হয়েছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল তৈরিতে ভারতের সহায়তা নেবে সরকার। এ জন্য ভারতের সঙ্গে একটি সম্পূরক চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। সম্পূরক চুক্তিটির খসড়া আজ সোমবার মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য তোলা হতে পারে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভারতের যুক্ততার বিষয়ে ১ মার্চ মস্কোতে রাশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। এমওইউ অনুযায়ী, ভারত শুধু যে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে রূপপুর প্রকল্পের জন্য জনবল প্রশিক্ষণ এবং প্রকল্পের জন্য পরামর্শসেবা দিয়ে সহায়তা করবে তা নয়, প্রকল্পের স্বার্থে ভারতীয় কোম্পানিগুলো প্রকল্পের নির্মাণ, যন্ত্রপাতি স্থাপন, এমনকি নিজের দেশে উৎপাদিত সামগ্রী এবং নিজেদের তৈরি কিছু কিছু যন্ত্রপাতিও (নন-ক্রিটিক্যাল ক্যাটাগরি) সরবরাহ করবে। ওই এমওইউতে সই করেন মস্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. সাইফুল হক, ভারতের রাষ্ট্রদূত পংকজ সরন ও রোসাতোম তথা রাশিয়ার প্রতিনিধি নিকোলাই স্পাস্কি।

গত বছর এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার ও উন্নয়নে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার লক্ষ্যে যে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, তার আওতায় ভারতের কাছ থেকে রূপপুর প্রকল্পের জন্য পরামর্শক সেবা নেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পের জন্য জনবল প্রশিক্ষণে ভারতের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। রূপপুর প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশি পেশাজীবীরা তামিলনাড়ুর কুদনকুলম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিতে শুরুও করেছেন।

এ ছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সরকার ভারতের ‘গ্লোবাল সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার এনার্জি পার্টনারশিপ (জিসিএনইপি)’-এর কাছ থেকে পরামর্শক সেবাও নিতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে জিসিএনইপির সঙ্গে শিগগিরই একটি চুক্তি সই হওয়ার কথা। এ জন্য চুক্তির খসড়া পাঠানো হয়েছে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য। এগুলো সবই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় নেওয়া হচ্ছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভারতীয় পরামর্শসেবা গ্রহণের জন্য একটি সম্পূরক চুক্তির খসড়ার সারসংক্ষেপ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল তৈরিতে ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি বিভাগের প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার এনার্জি পার্টনারশিপের (জিসিএনইপি)’ অভিজ্ঞতা ও সেবা নেওয়ার লক্ষ্যে একটি সম্পূরক চুক্তির প্রয়োজন। এর আগে গত বছর বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সঙ্গে ভারতের গ্লোবাল সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার এনার্জি পার্টনারশিপের একটি চুক্তি সই হয়েছে। এটি হবে ওই চুক্তিরই সম্পূরক চুক্তি।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন কারিগরি পরামর্শ ও বিশেষজ্ঞ সেবা গ্রহণের জন্য ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের সেবা নেওয়া হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি বিভিন্ন পর্যায়ে নির্মাণ করা ও নির্মাণ শেষে তা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের।

ঢাকা থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে পাবনার রূপপুরে পদ্মা নদীর পারে দেশের প্রথম এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত বছর অক্টোবরে প্রকল্পটির মূল নির্মাণপর্ব (ফাস্ট কংক্রিট পোরিং) শুরু হয়েছে। প্রতিটি ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিটবিশিষ্ট এই কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ২০২৩ সালে। দ্বিতীয় ইউনিটে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা এর পরের বছর। রাশিয়ার উদ্ভাবিত সর্বাধুনিক (থ্রি প্লাস জেনারেশন) ভিভিইআর-১২০০ প্রযুক্তির চুল্লি এই কেন্দ্রে বসানো হচ্ছে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ১ হাজার ২৬৮ কোটি ডলার ব্যয় ধরা হয়েছে। এর ৯০ শতাংশ রাশিয়া ঋণ হিসেবে দিচ্ছে। তবে এর বাইরেও এই প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজের জন্য আরও প্রায় ২০০ কোটি ডলার ব্যয় হবে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রের ধারণা।

রূপপুরে ভারতের যুক্ততা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভারত পৃথিবীর পরমাণু বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ‘নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপের (এনএসজি) সদস্য নয়। ওই গোষ্ঠীর সদস্য ছাড়া কোনো দেশ পরমাণু চুল্লি (রিঅ্যাক্টর) নির্মাণে সরাসরি অংশ নিতে পারে না। আবার রূপপুর প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সই হওয়া সাধারণ চুক্তি অনুযায়ী, প্রকল্পের পূর্ণ (এ টু জেড) বাস্তবায়নের দায়িত্ব রোসাতোম তথা রাশিয়ার। অর্থাৎ সব যন্ত্রপাতি নির্মাণ ও সরবরাহ তো বটেই, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলও তাদেরই সরবরাহ করার কথা।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশিষ্ট পরমাণু প্রকৌশলী, যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রায় ৩০ বছর কর্মকাল শেষে অবসর নেওয়া মো. নূরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে সই হওয়া সাধারণ চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ওই চুক্তি অনুযায়ী, প্রকল্পে এ টু জেড রাশিয়ারই করার কথা। ভারতের সরবরাহ করা সামগ্রী ও যন্ত্রপাতির কারণে (তা যতই মাইনর হোক না কেন) যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তার দায় কে নেবে? বাংলাদেশ, রাশিয়া নাকি ভারত?’