কোথাও ক্ষোভ কোথাও সন্তুষ্টি

>
  • ৩৪টি আসনে উপজেলা খণ্ডিত অবস্থায় আছে।
  • ইসির সীমানা নির্ধারণ প্রস্তাব নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদও ক্ষুব্ধ হয়েছেন
  • বিএনপি মনে করছে, আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধাজনক হবে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাবে অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আবার খুশি হয়েছেন কেউ কেউ। কোথাও ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ, কোথাও আবার বিএনপি। আবার কোনো কোনো জায়গার পুনর্বিন্যাস প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলই অখুশি।

গত বুধবার ৩৮টি সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তনের প্রস্তাবসহ ৩০০ আসনের সীমানার খসড়া প্রকাশ করে ইসি। মূলত উপজেলার অখণ্ডতা রক্ষার ওপর জোর দেওয়া হলেও এখনো ৩৪টি আসনে উপজেলা খণ্ডিত অবস্থায় আছে।

ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি  মনে করছে, সরকারি দলকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া এবং বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলার জন্য সীমানা পরিবর্তনের এই প্রস্তাব করা হয়েছে। দলটি স্থানীয় নেতা এবং নির্বাচনে লড়তে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ইসির প্রস্তাব সম্পর্কে আসনভিত্তিক নিজেদের মূল্যায়ন কেন্দ্রে পাঠাতে বলেছে। এরপর তারা এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরবে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সন্দেহ করছেন, ইসির প্রস্তাবিত এই পুনর্বিন্যাস হলে সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধাজনক হবে।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ও ইসির সীমানা পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত কমিটির প্রধান রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সীমানা নির্ধারণ প্রস্তাব তৈরিতে তাঁদের ওপর কোনো ধরনের রাজনৈতিক চাপ ছিল না। অনেক কিছু বিবেচনায় নিয়ে তাঁরা এই সীমানা বিন্যাসের কাজ করেছেন।

রফিকুল ইসলামের মতে, সব কটি উপজেলা অখণ্ড রাখা সম্ভব নয়। যেমন নড়াইলে তিনটা উপজেলায় সংসদীয় আসন দুটি। আবার কোথাও কোথাও জনসংখ্যার পার্থক্য আকাশচুম্বী হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু হওয়ার আগে শত শত দাবি ও আপত্তির কথা এলেও যেটুকু বিবেচনা করা গেছে, ইসি তা করেছে।

তবে ইসির সীমানা নির্ধারণ প্রস্তাব নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ইসির প্রস্তাব অনুযায়ী, ঢাকা-২ আসন হবে শুধু কেরানীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে। বিদ্যমান সীমানা অনুযায়ী কেরানীগঞ্জ উপজেলার একাংশ, ঢাকা সিটি করপোরেশনের একাংশ এবং সাভারের একাংশ নিয়ে এই আসন গঠিত। এ ছাড়া সাভার ও আশুলিয়ায় হবে দুটি আসন। ঢাকা-৩ এবং ঢাকা-১৯।

এভাবে আসন বিন্যাস হলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের বর্তমান আসন ঢাকা-২ পুরোপুরি পাল্টে যাবে। এই প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১০ বছর ধরে এই আসন নিয়ে কাজ করছেন। নির্বাচনের মাত্র ছয় মাস আগে সীমানা পরিবর্তন করে দেওয়া হবে, এটা হয় না।

ঢাকার এই বিন্যাস প্রস্তাব নিয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এসব আসন-সংশ্লিষ্ট বিএনপি নেতাদের দুজন কারাগারে। ঢাকা জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রামে ক্ষুব্ধ হাছান মাহমুদ, খুশি বিএনপি
চট্টগ্রাম-৭ হবে শুধু রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নিয়ে। এখন রাঙ্গুনিয়ার সঙ্গে বোয়ালখালীর দুটি ইউনিয়ন আছে এই আসনে। চট্টগ্রাম-৮ হবে বোয়ালখালী উপজেলা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫টি ওয়ার্ড নিয়ে। এই প্রস্তাবে অসন্তুষ্ট চট্টগ্রাম-৭ আসনের সাংসদ হাছান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বিন্যাসের ফলে তাঁর আসনে ভোটারসংখ্যা কমে যাচ্ছে। আর পাশের আসনে এমনিতে জনসংখ্যা বেশি, সেখানে আরও বেশি হচ্ছে।
তবে এই পরিবর্তন যৌক্তিক বলে মনে করে বিএনপি। এই আসনে হাছান মাহমুদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তাঁর ভাই বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এই পরিবর্তন অত্যন্ত যৌক্তিক।

নোয়াখালীতে ক্ষুব্ধ বিএনপি
ইসি প্রস্তাব করেছে নোয়াখালী-৪ হবে সুবর্ণচর ও নোয়াখালী সদর উপজেলা নিয়ে। এখন সুবর্ণচর ও দুটি ইউনিয়ন ছাড়া সদর উপজেলা নিয়ে এই আসন। নোয়াখালী-৫ আসন হবে কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলা নিয়ে। এখন কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট এবং সদরের দুটি ইউনিয়ন নিয়ে এই আসন। নোয়াখালী-৫ এ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ। মওদুদ আহমদ অভিযোগ করেন, যে দুটি ইউনিয়নে বিএনপির ভোট সবচেয়ে বেশি, সে দুটি ইউনিয়নকে সদরের সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় জনগণ এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানাবে।

কুমিল্লায় ক্ষুব্ধ বাহাউদ্দিন
দাউদকান্দি ও তিতাস উপজেলা নিয়ে কুমিল্লা-১ এবং হোমনা ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে কুমিল্লা-২ আসন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, এভাবে আসনের পুনর্বিন্যাস চান আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের নেতারাই।

কুমিল্লা-১ থেকে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইসির প্রস্তাবটি যৌক্তিক। কারণ, দাউদকান্দি ভেঙে তিতাস উপজেলার সৃষ্টি হয়েছে।

তবে কুমিল্লা-৬ নিয়ে ক্ষোভ আছে সরকারি দলের সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিনের। এই আসন ঘিরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের দ্বন্দ্ব আছে। কুমিল্লা সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনটি কুমিল্লা আদর্শ সদর, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এবং কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা নিয়ে করার প্রস্তাব হয়েছে। আ ক ম বাহাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আদমশুমারি না হলে সংসদীয় আসনের পুনর্গঠন করার কথা নয়। এখন যেভাবে কুমিল্লা-৬ আসন পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হবে।

এই আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমিন-উর রশীদ। তিনি মনে করেন, উন্নয়নের প্রশ্নে নতুন এই বিন্যাস ভালো হবে।

তবে কুমিল্লা-১০ আসন নিয়ে বিএনপির ক্ষোভ আছে। এই আসনের সীমানা নিয়ে রিট করেছিলেন বিএনপির সাবেক সাংসদ আবদুল গফুর ভূঁইয়া। এটি এখনো আপিল পর্যায়ে আছে। আবদুল গফুর যেভাবে চান, সেভাবে সীমানা হয়নি।

সাতক্ষীরায় দুই দলই অসন্তুষ্ট
সাতক্ষীরা-৩ আসন হবে আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলা নিয়ে। বিদ্যমান সীমানায় আশাশুনি, দেবহাটা এবং কালীগঞ্জের চারটি ইউনিয়ন নিয়ে এই আসন।
নতুন করে সাতক্ষীরা-৪ গঠিত হবে শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে।

পরিবর্তনের এই প্রস্তাব নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষোভ আছে। বিএনপিও মনে করে এই পরিবর্তন ভারসাম্য নষ্ট করবে।

সাতক্ষীরা-৩ আসনের সাংসদ আ ফ ম রুহুল হক বলেন, তিনি চান সংসদীয় আসন এখন যেভাবে আছে সেভাবে থাক। কারণ, উপজেলা খণ্ডিত অবস্থায় থাকলেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

সাতক্ষীরা-৪ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ জগলুল হায়দার চৌধুরী বলেন, তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আলোচনা করবেন।

সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সভাপতি রহমত উল্লাহ বলেন, উপজেলার অখণ্ডতা রক্ষা করতে গেলে এই দুটি আসন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।

শরীয়তপুরে ক্ষুব্ধ নাহিম, খুশি বিএনপি
শরীয়তপুর-২ আসন গঠিত হবে নাড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা নিয়ে। এখন নড়িয়া উপজেলা ও সখীপুর থানা নিয়ে এই আসন। নতুনভাবে শরীয়তপুর-৩ হবে ডামুড্যা ও গোসাইরহাট উপজেলা নিয়ে। এখন ডামুড্যা, গোসাইরহাট ও ভেদরগঞ্জ থানা নিয়ে এই আসন।

পরিবর্তনের এই প্রস্তাবে দুই সাংসদ অখুশি বলে জানা গেছে। শরীয়তপুর-৩ আসনের সাংসদ নাহিম রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও একই প্রস্তাব করেছিল ইসি। এবার আবারও একই প্রস্তাব কেন করা হলো, তা বোধগম্য নয়। তিনি জানান, খসড়া প্রকাশের পর থেকে এলাকাবাসীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।

তবে এই আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেতে আগ্রহী সাইদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এই বিন্যাস হলে প্রশাসনিক জটিলতা কমবে।

নীলফামারীর চাওয়া পূরণ
নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলাকে অখণ্ডিত রেখে আসন পুনর্বিন্যাসের দাবি জানিয়ে ইসিতে চিঠি দিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এছরারুল ইসলাম। স্থানীয় সূত্র জানায়, কিশোরগঞ্জের মানুষও চায় এটা। নীলফামারী-৪ আসনে কিশোরগঞ্জকে অখণ্ড রেখে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটা নিয়ে কারও খুব একটা ক্ষোভ নেই।

খুলনায়ও ইচ্ছাপূরণ
খুলনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেরই চাওয়া ছিল খুলনা-৩ আসনে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে দিঘলিয়ার আড়ংঘাটা ও যোগীপোল ইউনিয়নকে অন্তর্ভুক্ত করা। ইসিতে এই আবেদন জানিয়েছিলেন সরকারদলীয় সাংসদ মন্নুজান সুফিয়ান। একই আহ্বান ছিল বিএনপিরও। তাদের সে চাওয়া পূরণ হয়েছে।

জামালপুরে খুশি আওয়ামী লীগ
জামালপুর-৪ আসন হবে সরিষাবাড়ী উপজেলা নিয়ে। আর জামালপুর সদর উপজেলা নিয়ে হবে জামালপুর-৫ আসন। এখন সরিষাবাড়ী উপজেলা এবং জামালপুর সদরের দুটি ইউনিয়ন নিয়ে জামালপুর-৪।
জামালপুর-৫ আসনের সাংসদ রেজাউল করিম বলেন, তাঁরা এই পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন।

আরও পরিবর্তন
নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের হাতে থাকা নারায়ণগঞ্জ-৪ ও ৫ আসনে পরিবর্তন প্রস্তাব করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ আওয়ামী লীগের শামীম ওসমান। পাশের আসনে তাঁর ভাই জাতীয় পার্টির সেলিম ওসমান। শামীম ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, যে পরিবর্তনই আসুক তাঁর কোনো সমস্যা নেই। তবে বিএনপি মনে করে সিটি করপোরেশনকে ভাঙা ঠিক হবে না।

জাতীয় পার্টি-অধ্যুষিত রংপুরে এইচ এম এরশাদের আসনসহ তিনটি আসনে পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এখানে আসনের সীমানায় পরিবর্তনে জাতীয় পার্টির তেমন লাভ-ক্ষতি নেই।

পাবনার স্থানীয় সূত্র জানায়, সেখানকার পাবনা-১ ও ২ আসনের সীমানা পরিবর্তন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। পাবনা-২ নিয়ে অখুশি আওয়ামী লীগ। তারা বর্তমান সীমানার বহাল চায়। আবার ১ আসন নিয়ে দলের একটি অংশ খুশি।

জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির উপকরণগুলোর একটি। তাই সব দিক চিন্তা করে এ বিষয়ে ইসির এগুনো উচিত। এই সীমানা বিন্যাসের প্রস্তাব কতটুকু যুক্তিযুক্ত হয়েছে, তা সীমানা নির্ধারণের প্রস্তাবের বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত জানার পর বোঝা যাবে।

সাধারণত জনসংখ্যাকে প্রাধান্য দিয়ে সীমানা নির্ধারণের কথা উল্লেখ করে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তাতে ভারসাম্য থাকে। এর সঙ্গে প্রশাসনিক সুবিধাও বিবেচনায় নিতে হয়। তবে তাঁর মতে, শুধু উপজেলার অখন্ডতা রক্ষা করা কঠিন। সেটা সম্ভবও নয়। এখন যেসব উপজেলা খন্ডিত রয়ে গেছে সেখানে প্রশ্ন ওঠতে পারে।