কোটা সংস্কারের দাবি কতটা যৌক্তিক?

কোটা সংস্কারের দাবিতে সরব হয়েছে তরুণদের একটি বড় অংশ। তাঁদের দাবি, বিদ্যমান কোটাপদ্ধতিতে সংস্কার আনা প্রয়োজন। এটি করা না হলে মেধাবীরা বঞ্চিত হবেন। বিভিন্ন গবেষণা, সুপারিশেও বলা হচ্ছে, বর্তমান বাস্তবতায় সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি।

বর্তমানে সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা আছে। ফলে ১০০ জন নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা থেকে নিয়োগ হয় ৫৬ জন। অবশিষ্ট ৪৪ জনকে নেওয়া হয় মেধা থেকে। আর যদি কোটা থেকে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না যায়, তাহলে তা শূন্য রাখা হয়। ফলে স্বপ্নের কাছাকাছি এসেও কোটার কারণে ছিটকে পড়তে হয় মেধাবীদের।

জনপ্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিসিএসে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও তাঁদের নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ কোটা। এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা রয়েছে ১ শতাংশ, যা পূরণ করা হয় সাধারণত ওপরের যেকোনো একটি কোটা থেকে। অর্থাৎ কোনো কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেখান থেকে প্রতিবন্ধী কোটা পূরণ হয়।

সরকারি বিভিন্ন নিয়োগ কার্যক্রম থেকে দেখা গেছে, নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়াদের মধ্যে সিংহভাগেরই কোটার সুবিধা থাকে না। অথচ সেখান থেকে কম প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে কোটার সুবিধা নিয়ে যাঁরা নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন, তাঁরা সংখ্যায় কম হলেও তাঁদের জন্য পদ থাকে বেশি। ফলে দেখা যায়, কোটার পদ পূরণের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য প্রার্থী থাকছে না। এতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা সব পদ পূরণ করা সম্ভব হয় না। এতে দুই ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। এক, ওই পদ সংরক্ষিত থাকার কারণে মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। দুই, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় জনবল পাচ্ছে না।

বর্তমান বাস্তবতায় কোটা সংস্কারপন্থীরা কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া, শুধু কোটাকেন্দ্রিক বিশেষ পরীক্ষা না নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে কোটার পক্ষে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা যেকোনো নিয়োগ পরীক্ষার প্রিলিমিনারি (প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষা) থেকে কোটাব্যবস্থা চালুর দাবিতে সরব হয়েছেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, বর্তমানে ২৫৮ ধরনের কোটা আছে। চাকরিতে এই কোটাব্যবস্থা অবশ্যই সংস্কার করা উচিত। প্রথমত, জেলা কোটা উঠিয়ে দিয়ে বিভাগীয় কোটা চালু করলে এমনিতেই অনেক মেধাবী চলে আসবে। আর মুক্তিযোদ্ধা, নারী, উপজাতিসহ অন্যান্য কোটা সার্বিক মেধার ভিত্তিতে হওয়া উচিত, বিভাগীয় কোটার ভিত্তিতে নয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকতে পারে। তবে অনগ্রসর হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কেবল যাঁরা ভাতা পান, দুস্থ হিসেবে যাঁদের সরকারিভাবে বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের সন্তানদের জন্য কোটা থাকতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত এই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে কোটা রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল। আরেকটি সুপারিশ হলো কোটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা নয়। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের কোটা যেমন চিরস্থায়ী ভিত্তিতে করা হয় না, এটাও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য করা হয়। প্রত্যেক কোটারই নির্দিষ্ট সীমা থাকবে। সে জন্য পাঁচ বছর পরপর কোটা পর্যালোচনা করা উচিত।

পিএসসি সূত্র জানা গেছে, কোটার প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১৩ জনের পদ শূন্য ছিল। একইভাবে ২৯তম ৭৯২ জন, ৩০ তম ৭৮৪ জন, ৩১ তম ৭৭৩ জন, ৩৫ তম-তে ৩৩৮ জনের পদ শূন্য ছিল। এই শূন্য পদ না রেখে সেখানে মেধা থেকে প্রার্থী নিয়োগের দাবি তাঁর।

ব্যাংকে নিয়োগের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যসচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন খান বলেন, ব্যাংকের চাকরিতেও একই কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ফলে কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে ওই পদগুলো শূন্য রাখা হয়।

সূত্র বলছে, কোটা থাকায় ব্যাংকে প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে শত শত প্রার্থীর পদ খালি থাকছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষও এ বিষয়টি স্বীকার করেছে। তাদের মত, কোটা থেকে প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেটা মেধা থেকে নিয়োগ করা গেলে মেধাবীরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি রাষ্ট্রের সরকারি ব্যাংকগুলোতেও জনবল–সংকট দূর হবে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সমাজে ক্ষোভ সৃষ্টিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাকরির সুযোগ লাভে সমতার যে সাংবিধানিক অঙ্গীকার, তার বিপরীতে যুগ যুগ ধরে ভিন্ন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের সংবিধান বলছে, প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে সবার নিয়োগলাভের সমান অধিকার থাকবে। অথচ এখন উচ্চতর সিভিল সার্ভিসের মেধার মাধ্যমে নিয়োগ পান ৪৪ শতাংশ প্রার্থী।’ তিনি বলেন, পিএসসি ২০০৮ সালে ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় দুজন সাবেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তার মাধ্যমে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। তাঁরা গোটা ব্যবস্থাটিকে অন্যায্য এবং জনপ্রশাসনের জন্য ক্ষতিকর বলে মতামত দেন। সুপারিশ রাখে প্রাধিকার কোটায় বড় ধরনের হ্রাসের। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইজিএস একটি গবেষণামূলক নিবন্ধেও অনুরূপ সুপারিশ রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল এক নিবন্ধে লিখেছেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে, নারী কিংবা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে ‘উপজাতিদের’ জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় কোটা থাকতে পারে। সংবিধানের ২৯ (৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের ‘অনগ্রসর অংশের’ জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে, ‘অনগ্রসর অঞ্চলের’ জন্য নয়। ফলে জেলা কোটার সাংবিধানিক ভিত্তি নেই বলা যায়। সংবিধান অনুসারে মুক্তিযোদ্ধা কোটারও কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তাই মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষ করে তাঁদের সন্তানেরা ঢালাওভাবে অনগ্রসর অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন না।