স্বজনদের কাঁদিয়ে শেষ বিদায়

নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত মাহমুদুর রহমানের লাশ বাড়িতে পৌঁছামাত্র বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মা লিলি বেগম। গতকাল সকালে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার লস্করদিয়া গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত মাহমুদুর রহমানের লাশ বাড়িতে পৌঁছামাত্র বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মা লিলি বেগম। গতকাল সকালে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার লস্করদিয়া গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত বাংলাদেশিদের মধ্যে ২৩ জনের মরদেহ শনাক্ত করার পর গত সোমবার আনা হয় দেশে। আর্মি স্টেডিয়ামে জানাজা শেষে পাঠানো হয় তাঁদের নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে। গতকাল মঙ্গলবার তাঁদের শায়িত করা হলো কবরে। স্বজনদের কাঁদিয়ে তাঁরা অকালেই নিলেন শেষ বিদায়।

গতকাল ভোরে মাহমুদুর রহমানের (৩০) মরদেহ ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার লস্করদিয়া গ্রামে পৌঁছায়। এ সময় তাঁর মায়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে বাড়ির পরিবেশ। তিনি আর্তনাদ করে বলেন, ‘ও বাবা, কোথায় তুমি আমারে মাটি দিয়া যাবা, আজ তোমারে আমাদের মাটি দিতে হবে।’

সকাল ১০টায় লস্করদিয়া আতিয়ার রহমান উচ্চবিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গণে মাহমুদুরের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে তাঁদের বাড়িতে আসেন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক উম্মে সালমা তানজিয়া। তিনি মাহমুদুরের মায়ের হাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা তুলে দেন।

কথা হয় মাহমুদুরের চাচা যশোর মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শাহ মো. ইকবালের সঙ্গে। তিনি বলেন, মা লিলি বেগম, বাবা এস এম মসিউর রহমান ও ছোট ভাই এস এম মোকলেসুর রহমানকে নিয়ে ছিল মাহমুদুরের সংসার। তাঁর উপার্জনের টাকাতেই চলত পরিবারটি। এখন কীভাবে চলবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।

স্বামীকে ছাড়াই শেষ বিদায়

আক্তারা বেগমের মরদেহ প্রথমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বেগুনবাড়ি গ্রামে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে নেওয়া হয় রাজশাহীতে শ্বশুরবাড়িতে। গতকাল সকালে নগরের উপশহর ক্রীড়া সংঘের মাঠে জানাজা শেষে গোরহাঙ্গা গোরস্থান মসজিদের পাশে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজায় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন, সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার প্রমুখ অংশ নেন।

আক্তারা বেগম উপশহরের নজরুল ইসলামের স্ত্রী। নেপালে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নজরুল ইসলামও নিহত হয়েছেন। তবে তাঁর মরদেহ শনাক্ত না হওয়ায় এখনো দেশে আসেনি।

ছেলের লাশ দেখে নির্বাক বাবা

বৈশাখী টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার ফয়সাল আহমেদের মরদেহ সোমবার দিবাগত রাত তিনটায় তাঁর গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের ডামুড্যায় পৌঁছায়। গতকাল সকাল ১০টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফয়সালকে শেষ দেখাও দেখতে পারেননি। ছেলের লাশ দেখে ফয়সালের বাবা সামসুদ্দীন সরদার নির্বাক হয়ে যান। তাঁর শব্দহীন কান্নায় অন্যরাও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।

ছোটই চলে গেলেন সবার আগে

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার বগাদানা ইউনিয়নের আউরারখিল গ্রামের মতিউর রহমান পলাশেরও (২৯) দাফন সকালে সম্পন্ন হয়েছে। জানাজার আগে পরিবারের ইচ্ছায় তাঁর মা লাশ দেখেন।

মতিউর আউরারখিল গ্রামের মৃত মো. আমিন উল্যাহ মিয়ার ছেলে। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। অথচ তিনিই চলে গেলেন সবার আগে।

চিরনিদ্রায় মা-বাবা-সন্তান

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার আমিশাপাড়া ইউনিয়নের কেশারখিল গ্রামের বাসিন্দা রফিক জামান। বিমান দুর্ঘটনায় তিনি, তাঁর স্ত্রী সানজিদা হক ও সাত বছর বয়সী ছেলে অনিরুদ্ধ নিহত হয়। তিনজনকেই গতকাল সকালে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তাঁদের জানাজায় অন্যদের মধ্যে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।

প্রিয় বারান্দার নিচেই শায়িত বাবা-মেয়ে

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগরহাওলা গ্রামের বাড়িতে সোমবার রাত পৌনে আটটায় পৌঁছে এফ এইচ প্রিয়ক ও তাঁর মেয়ে প্রিয়ন্ময়ীর লাশ। তখন বাড়িজুড়ে কান্নার রোল। গতকাল সকালে দুই দফা জানাজা শেষে বাড়ির প্রিয় ঝুল বারান্দা লাগোয়া উঠানে তাঁদের কবর দেওয়া হয়। প্রিয়কের বন্ধু সোহানুর রহমান বলেন, এই বারান্দা ছিল প্রিয়ক, তাঁর স্ত্রী অ্যানি ও সন্তানের খুব পছন্দের।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নোয়াখালী এবং প্রতিনিধি, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, সোনাগাজী ও শ্রীপুর]