ওষুধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মা এখন বড় ঝুঁকি

>
  • বছরে ৩,৬০,০০০ মানুষ যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়
  • বছরে যক্ষ্মায় মৃত্যু ৬৬ হাজার, দৈনিক ১৮০
  • এমডিআর যক্ষ্মার ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে

রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের দোতলার একটি কক্ষ এখন মো. আমানত আলীর ঠিকানা। খুবই জটিল ধরনের যক্ষ্মায় তিনি আক্রান্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তিনি ‘এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ বা এক্সডিআর যক্ষ্মারোগী। তাঁকে সাধারণ যক্ষ্মারোগীদের কাছ থেকেও আলাদা করে রাখা হয়েছে। দেশে এই ধরনের রোগী বাড়ছে।

২২ মার্চ আমানত আলীর সঙ্গে ওই হাসপাতালে কথা হয়। মুখে মাস্ক থাকায় চোখমুখ ঠিকমতো দেখা যায় না। দ্রুত কথা বলেন। গলায় জোর এনে কথা বলার চেষ্টা করেন। দুর্বল শরীর। তাঁকে দৈনিক ২৬টি বড়ি ও ক্যাপসুল খেতে হচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, ২৪ মাস এভাবে ওষুধ খেয়ে যেতে হবে।

আমানত আলীর বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার গোয়ালবেড়া গ্রামে। তিনি একটি মাধ্যমিক পাইলট স্কুলের শিক্ষক। ২০১৭ সালের এপ্রিলে তাঁর যক্ষ্মা শনাক্ত হয়। শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই ছয় মাস নিয়মিত যক্ষ্মার ওষুধ খেয়েছিলেন। ছয় মাসের ওষুধ শেষ হওয়ার পর চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, তিনি যক্ষ্মামুক্ত, সুস্থ হয়ে গেছেন।

আমানত আলী বলেন, ‘ভালো হওয়ার দুই মাস পর আবার কাশি শুরু হয়, অসুস্থ বোধ করি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমাকে নেত্রকোনার অনন্তপুরে পাঠানো হয় এমডিআর (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট) যক্ষ্মার চিকিৎসার জন্য। সেখান থেকে পাঠানো হয় এই বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। এ বছরের ১৭ জানুয়ারি থেকে এই হাসপাতালে আছি।’

যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ আসিফ মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ যক্ষ্মারোগীকে নিয়ম মেনে দৈনিক ওষুধ খেতে হয় টানা ছয় মাস। ছয় মাসের কোর্স শেষ না করলে, নিয়ম মেনে ওষুধ না খেলে, মানসম্পন্ন ওষুধ না খেলে চিকিৎসা কার্যকর হয় না। যক্ষ্মার জীবাণু ওষুধসহনশীল হয়ে পড়ে। ওই ওষুধে জীবাণু ধ্বংস হয় না, রোগী ভালো হয় না। এটাই এমডিআর যক্ষ্মা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে এমডিআর যক্ষ্মারোগী আছে ৫ হাজার ৩০০। জাতিসংঘের বিশেষায়িত এই সংস্থাটি বিশ্বের যে গুটিকয়েক দেশকে এমডিআর যক্ষ্মার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, বাংলাদেশ তার একটি।

সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এতকাল এক্সডিআর যক্ষ্মার অর্থই ছিল অবধারিত মৃত্যু। আবিষ্কৃত নতুন দুটি ওষুধ ২০১৫ সাল থেকে ব্যবহার শুরু হওয়ায় কিছুটা আশার আলো দেখছেন চিকিৎসকেরা।

বর্তমানে আমানত আলীসহ ১৫ জন এক্সডিআর রোগী আছে বলে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি জানিয়েছে। তাঁদের মধ্যে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি আছেন চারজন। চারজনের একজন নারী। অন্য ১১ জনের বাড়িতে চিকিৎসা চলছে। তাঁদের মধ্যে ঢাকা শহরে আছেন চারজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত হিসেবে দেশে এক্সডিআর রোগী আছেন ৫৩০ জন।

সাধারণ যক্ষ্মার রোগী যেমন বাতাসে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়, তেমনি এমডিআর বা এক্সডিআর যক্ষ্মার রোগী সরাসরি এমডিআর বা এক্সডিআর যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়। সেই কারণে আমানত আলীকে অন্য রোগী থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে।

আমানত আলী কীভাবে এক্সডিআর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেন, তার সঠিক কারণ জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা চিহ্নিত করতে পারেননি। আমানত আলী প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর বাড়ির পাশের একজন যক্ষ্মার (সাধারণ) রোগীকে তিনি মাঝেমধ্যে ওষুধ খাওয়াতেন। ওই রোগী সুস্থ হয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি কীভাবে এই জটিল যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেন, তা তিনি জানেন না।

দেশে এমডিআর ও এক্সডিআর যক্ষ্মার প্রকোপ বাড়ছে। ওষুধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণই এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আসিফ মোস্তফা বলেন, প্রথমত সব রোগীকে চিহ্নিত করা ও চিকিৎসার আওতায় আনা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত যারা চিহ্নিত হচ্ছে, তাদের অনেকের চিকিৎসা কার্যকরভাবে শেষ হচ্ছে না। জাতীয় কর্মসূচিতে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি জনসচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

জানতে চাইলে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বিষয়ভিত্তিক পরিচালক শামিউল ইসলাম বলেন, সরকার যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই ওষুধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মার রোগী শনাক্ত ও চিকিৎসা করছে। বর্তমানে সরকারি ছয়টি ও বেসরকারি ডেমিয়েন ফাউন্ডেশনের তিনটি হাসপাতালে এসব রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে। আর ১৯২টি কেন্দ্রে এই রোগ শনাক্তের বিশেষ যন্ত্র (জিন এক্সপার্ট) আছে।

সরকারি তথ্য বলছে, ৮০ শতাংশ এমডিআর রোগী শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে এমডিআর রোগীর অনুমিত সংখ্যা ৫ হাজার ৩০০। বর্তমানে চিকিৎসার আওতায় আছেন ৯২০ জন।

এই পরিস্থিতিতে আজ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হচ্ছে। সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয় না। দিবসটি উপলক্ষে আজ শনিবার সকালে ২৬টি এনজিওর উদ্যোগে একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য: ‘নেতৃত্ব চাই যক্ষ্মা নির্মূলে, ইতিহাস গড়ি সবাই মিলে’।