বিএনপির ৮ নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে দুদক

ওপরে বাঁ দিক থেকে নজরুল ইসলাম খান, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও এম মোর্শেদ খান; নিচে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও মির্জা আব্বাস, হাবিব উন নবী খান সোহেল ও তাবিথ আউয়াল।
ওপরে বাঁ দিক থেকে নজরুল ইসলাম খান, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও এম মোর্শেদ খান; নিচে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও মির্জা আব্বাস, হাবিব উন নবী খান সোহেল ও তাবিথ আউয়াল।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির নানা অভিযোগের ভেতরেই দলটির শীর্ষ আট নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে সংস্থাটি। তাঁদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, সন্দেহজনক ব্যাংক লেনদেনসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই বিএনপি নেতারা বলছেন, তাঁদের চাপে রাখতেই সরকারের কৌশলের অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নিয়েছে দুদক।

যেসব নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, তাঁরা হলেন স্থায়ী কমিটির চার সদস্য—খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও মির্জা আব্বাস; দুই ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও এম মোর্শেদ খান; যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল, আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে ও দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল। এ ছাড়া এম মোর্শেদ খানের ছেলে ফয়সাল মোর্শেদ খানের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান হচ্ছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছেন উপপরিচালক সামছুল আলম। চলতি সপ্তাহেই এঁদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে চিঠি পাঠাবে সংস্থাটি। পাশাপাশি তাঁদের সম্পদের হিসাবও জমা দিতে বলবে প্রতিষ্ঠানটি।

দুদকের মামলায় সাজা পেয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ ছাড়া বিএনপির ২৫ জনের বেশি জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধেও দুদকের করা দুর্নীতির মামলা চলছে। দলটি দীর্ঘদিন ধরেই দুদকের সমালোচনায় মুখর। গত ২১ মার্চ দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘দুদক রাতকানা বাদুড়ের মতো। একে দায়িত্বই দেওয়া হয়েছে বিএনপির নেত্রী ও নেতাদের বিরুদ্ধে খড়্গ চালিয়ে যাওয়ার জন্য।’

সূত্র জানায়, একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে খবর প্রকাশ হয়, ৩০ দিনে এসব ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব থেকে ১২৫ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে। সেই সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।

সূত্রটি বলছে, যাদের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক অর্থ উত্তোলনের তথ্য পাওয়া গেছে, তাঁদের কয়েকজনই প্রথিতযশা ব্যবসায়ী। ওই পরিমাণ অর্থ লেনদেন অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বড় অঙ্কের ওই সব লেনদেন নগদে হওয়ায় তাঁদের বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এই নগদ অর্থ উত্তোলন ব্যবসায়িক লেনদেনের বাইরে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা হবে।

যে অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদক অনুসন্ধানে নেমেছে, তাতে বলা হয়, তিনটি বেসরকারি ব্যাংকে আবদুল আউয়াল মিন্টুর হিসাব থেকে ১১, ১৫ ও ২২ ফেব্রুয়ারি মোট ৩২ কোটি টাকা তোলা হয়। একই মাসে তাঁর ছেলে তাবিথ আউয়ালের হিসাব থেকে তোলা হয় ২০ কোটি টাকা।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোর্শেদ খানের ব্যাংক হিসাব থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি তোলা হয় ১৮ কোটি টাকা। তাঁর ছেলে ফয়সাল মোর্শেদ খানের হিসাব থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি তোলা হয় ৯ কোটি টাকা।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন ৩ থেকে ১২ মার্চের মধ্যে একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ১২টি চেকের মাধ্যমে ২১ কোটি টাকা তুলেছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি চেকে টাকা তোলা হয়েছে ঢাকার বাইরে থেকে।

২৮ ফেব্রুয়ারি ও ৪ মার্চ ঢাকা ব্যাংকে মির্জা আব্বাসের হিসাব থেকে ১৬ কোটি টাকা তোলা হয়। এ ছাড়া নজরুল ইসলাম খান এবং হাবিব উন নবী খান সোহেলের ব্যাংক হিসাব থেকে বিভিন্ন সময়ে ৭ কোটি টাকা ‘সন্দেহজনক লেনদেন’ হয়েছে বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের একটি খবর গত ১৭ মার্চ বাংলা ইনসাইডার নামের একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশ হয়েছিল; যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ওই অনলাইনটির মালিক কে, কারা এটি চালায়, তা সমাজের সচেতন মহল জানেন। ওই ভিত্তিহীন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দুদক এখন অনুসন্ধান চালাবে। এ ধরনের পলিটিসাইজড বিষয়ে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষপাতমূলক তৎপরতা তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দু-একটি ‘হাওয়াই অনলাইনে’ প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে দুদক অনুসন্ধান করছে, তার কতটা ভিত্তি আছে? তিনি বলেন, ‘যে ব্যাংকের লেনদেনের কথা বলা হয়েছে, সেখানে আমার বা আমার পরিবারের কারও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কখনোই ছিল না, এখনো নেই।’

খন্দকার মোশাররফ বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির কথা যেখানে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আছে, সেগুলো নিয়ে দুদকের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের মাথাব্যথা ‘হাওয়াই’ প্রতিবেদন নিয়ে। দুদকের এ কার্যক্রমকে রাজনৈতিক হিসেবে মন্তব্য করেন তিনি।

দলের আরেক শীর্ষ নেতা নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয়, তাঁদের চাপে রাখতে সরকারের একটি কৌশল। শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের না ধরে আমাদের নিয়ে দুদক কেন টানাটানি করছে, সেটা সবাই বোঝে।’

এ বিষয়ে দুদকের উচ্চপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তাই মুখ খুলতে রাজি হননি। দুদকের মুখপাত্র ও সচিব শামসুল আরেফিনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়ার পরও তিনি ফোন ধরেননি। বক্তব্য জানতে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা আশা করি, দুদক আইনি পরিমণ্ডলে থেকেই তাদের দায়িত্ব পালন করবে। তারা যদি ব্যক্তি বা রাজনৈতিক পরিচয় দেখে কোনো অনুসন্ধান করে, তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’