মেয়েদের রুখে দাঁড়াতে বলছে পুলিশ

২০ বছর আগের ঘটনা। ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বাংলা একাডেমি এলাকায় চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। চারজন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হল থেকে বের হয়ে বইমেলায় গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন তরুণী শাড়ি পরা ছিলেন। মেলার প্রবেশপথে বেশ কয়েকজন যুবক শাড়ি পরা শিক্ষার্থীদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আকস্মিক এ ঘটনায় চিৎকার করতে থাকেন তাঁরা। তিন সহপাঠীকে রক্ষায় ওই সময় চতুর্থজনই অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। প্রতিবাদ করেন তীব্রভাবে। তাঁর কারণেই ওই দিন বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা থেকে রক্ষা পান তাঁর তিন সহপাঠী। ওই তরুণী (চতুর্থজন) এখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।

তবে দুই দশক পেরিয়ে গেলেও উন্মুক্ত স্থানে নারীদের লাঞ্ছিত হওয়া, যৌন হয়রানির ঘটনা কমছে না। গত ২৩ মার্চ চাঁদনি চকের বলাকা মার্কেটের নিচতলায় শাহনূর ফেব্রিকসের দোকানিরা প্রকাশ্যে ইডেন মহিলা কলেজের তিন ছাত্রীর গায়ে হাত দেন। পরদিন তিন ছাত্রী নিউমার্কেট থানায় মামলা করেন। এ ছাড়া গত মার্চ মাসে রাজধানী ঢাকায় নারীদের লাঞ্ছিত হওয়ার আরও বেশ কিছু ঘটনা প্রকাশ পায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয়। ভুক্তভোগী নারীরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে হেনস্তার শিকার হওয়ার ঘটনা জানান।

তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মতে, যত ঘটনা ঘটছে, সে তুলনায় প্রতিবাদের ঘটনা ঘটে সামান্যই। বেশির ভাগ নারী আরও হেনস্তা হওয়ার ভয়ে তা প্রকাশ করতে চান না। আবার সাহস করে অল্প কয়েকজন নারী প্রতিবাদ করলেও আইনের দ্বারস্থ হতে চান না। ফলে এসব অভিযোগে মামলা করার ঘটনা একেবারেই হাতেগোনা। আবার অনেক সময় মামলা হলেও নানান জটিলতায় বিচারপ্রক্রিয়া হয়ে যায় দীর্ঘ।

উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপকমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীরা অনেক সময় ফোনে তাঁদের কাছে অভিযোগ করে থাকেন। অভিযোগ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট থানার মাধ্যমে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়ে থাকে। অথবা ভুক্তভোগী নারীর কাছে থানার ফোন নম্বর দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় নারীকে ভীত হওয়া যাবে না। তাঁকে সাহসী, প্রতিবাদী, সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। কারণ, এসব ঘটনায় হীনম্মন্যতায় ভুগলে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।’

গত ৭ মার্চে রাজধানীর বাংলামোটরে এক স্কুলছাত্রী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় মামলা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। মামলাটি পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তদন্ত করছে। ডিএমপির উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফুটেজ দেখে আসামিদের শনাক্ত করার কাজ চলছে।

রাজধানীতে প্রতিদিন কত নারী লাঞ্ছনার শিকার হন বা যৌন হয়রানির শিকার হন, সে সম্পর্কে কোনো সংস্থাই আলাদাভাবে হিসাব রাখে না। আর পুলিশের কাছে অভিযোগও আসে না। এ কারণে নগরীতে নারীদের এই লাঞ্ছনার বেশির ভাগ ঘটনাই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন থেকে জানা গেছে, ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত শ্লীলতাহানির ৯৩টি মামলা হয়েছে। গণপরিবহনে লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার ঘটনায় গত তিন বছরে ছয়টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

শুধু ঢাকার হিসাব না থাকলেও সারা দেশের একটি চিত্র রয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) কাছে। আসকের হিসাব অনুসারে, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬২ মাসে সারা দেশে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১ হাজার ১৪৮ নারী। এর মধ্যে ৯৩১ জন নারী বখাটের দ্বারা লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। গড়ে প্রতি মাসে ১৫ জন নারী লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। আর গড়ে ১৮ জনের বেশি নারী প্রতি মাসে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গত ছয় বছরে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে প্রাণ গেছে ১০৬ নারীর। এর মধ্যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন ৭৩ জন নারী এবং যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় খুন করা হয়েছে ৩৩ নারীকে।

যৌন হয়রানির বিরুদ্ধের সোচ্চার হচ্ছেন মেয়েরা। প্রথম আলো ফাইল ছবি
যৌন হয়রানির বিরুদ্ধের সোচ্চার হচ্ছেন মেয়েরা। প্রথম আলো ফাইল ছবি

আসকের এই পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি ২০৫ নারী লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। বাকি চার বছরের মধ্যে ২০১২ সালে ১৮৩ জন, ২০১৩ সালে ১২০, ২০১৪ সালে ১১৫, ২০১৬ সালে ১৩৮ এবং ২০১৭ সালে ১৫১ জন লাঞ্ছনার শিকার হন। ২০১৮ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯ নারী লাঞ্ছনার শিকার হন। এ ছাড়া যৌন হায়রানির কারণে ৪৬ জন মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রাজপথ, গণপরিবহন কিংবা বিপণিবিতানের মতো উন্মুক্ত স্থানগুলোয় নারীদের লাঞ্ছনা হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, গৃহবধূ থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সী নারীরা কোনো না কোনো সময়ে যৌন হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হন। গণপরিবহনগুলোয় নারীরা বেশি লাঞ্ছনার শিকার হয়ে থাকেন।

অন্যদিকে, শহরাঞ্চলে পোশাক কারখানার নারী কর্মীরা কাজ থেকে ফেরার পথেও নানাভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়ে থাকেন। গত ২৪ মার্চ রাত ১০টার দিকে পোশাক কারখানার এক কর্মী কারখানা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ১০-১২ জন বখাটে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় মিরপুরের পল্লবীর ১৩ নম্বর সড়কের একটি নির্মাণাধীন ভবনে। পরে পল্লবী থানার পুলিশ ওই বাড়ি থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার ও তিনজনকে আটক করে। এ ঘটনায় বাদী হয়ে মেয়েটি নিজেই পল্লবী থানায় মামলা করেন।

পোশাককর্মীদের লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, পোশাকশ্রমিকেরা এসব ঘটনায় আইনি সহায়তা পান না। তিনি বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে পোশাককর্মীদের। এ ছাড়া তাঁদের সংঘবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করতে বলা হয়েছে।

২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি হাইকোর্টের এক রায়ে উত্ত্যক্তকরণকে যৌন হয়রানি হিসেবে বিবেচনা করে আইনের অন্তর্ভুক্ত করে সাত দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর আগে যৌন হয়রানি রোধে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট একটি নীতিমালা দিয়েছিলেন। যৌন নিপীড়ন ও শ্লীলতাহানি রোধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী জরিমানাসহ সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।