ভোগান্তি-অভিযোগ-জরিমানার চক্রে হজের ব্যবস্থাপনা

প্রতি মৌসুমে হজযাত্রীদের অনেকেই হয়রানিতে পড়ছেন। হজ শেষে তাঁদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় কিছু হজ এজেন্সির লাইসেন্স বাতিলসহ জরিমানা করে। তাতে মন্ত্রণালয়ের আর্থিক লাভ হলেও ভুক্তভোগী হজযাত্রীদের কোনো উপকার হয় না। পরের হজ মৌসুমে হজযাত্রীদের আবার একই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ভোগান্তি, অভিযোগ ও জরিমানার এই চক্রেই চলছে হজের ব্যবস্থাপনা।
এ বছর বাংলাদেশ থেকে হজে যাবেন ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাত হাজার এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ২০ হাজার ১৯৮ জন হজে যেতে পারবেন। প্রথম হজ ফ্লাইট ১৪ জুলাই।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও হজসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এবারও ভোগান্তি-অভিযোগ-জরিমানার চক্র থেকে হজের ব্যবস্থাপনা বের হওয়ার সম্ভাবনা কম। অথচ প্রতিবছরই হজের খরচ বাড়ছে। এই চক্র থেকে বের হয়ে আসতে এবং হজযাত্রাকে স্থায়ী ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হজ আইন প্রণয়ন করতে হবে। যদিও ছয় বছর আগে একটি খসড়া হজ আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হলেও তা চূড়ান্ত হয়নি।
হজের মৌসুমে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব দুই দেশেই হজযাত্রীদের নানা ধরনের হয়রানিতে পড়তে হয়। গতবার হজযাত্রীরা বাংলাদেশ অংশে এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতারণা, ভুয়া চুক্তি, টাকা নিয়ে এজেন্সির প্রতিনিধির পালিয়ে যাওয়াসহ নানা অভিযোগ করেন। সৌদি আরবে পৌঁছানোর পর চুক্তিহীন বাড়িতে রাখা, এক বাড়ির হজযাত্রীকে অন্য বাড়িতে ওঠানো, নিম্নমানের খাবার, চুক্তি অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত সুবিধা না দেওয়াসহ নানা অনিয়ম ও প্রতারণা অভিযোগ তো রয়েছেই।
হজযাত্রীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর হজে প্রতারণা, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার জন্য প্রায় চার শ এজেন্সির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ৬৪টি এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়। এ ছাড়া এজেন্সিগুলোকে বিভিন্ন পরিমাণে মোট প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। সতর্ক করা হয়েছে আড়াই শ এজেন্সিকে।
তবে জরিমানা, লাইসেন্স বাতিলের মতো শাস্তি দিয়ে হজের অব্যবস্থাপনা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যাবে না বলে মনে করেন হজ এজেন্সিজ অব বাংলাদেশের (হাব) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম বাহার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয় হজ নীতিমালা ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারে না। হজ কার্যক্রমে শৃঙ্খলা আনতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে জাতীয় হজ পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে তা পরিচালনা করতে হবে।
হজযাত্রীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেলেও সরকার প্রতিবছর হজের খরচ বাড়াচ্ছে। হজ মৌসুমে এজেন্সিগুলো হজযাত্রী সংগ্রহে মরিয়া হয়ে ওঠে।
দুটি হজ এজেন্সির মালিক প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিযোগিতার কারণে এজেন্সিগুলো সরকার-নির্ধারিত প্যাকেজের কম মূল্যে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকাতেও হজে পাঠাতে চুক্তিবদ্ধ হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীরা হজযাত্রীদের কাছ থেকে প্যাকেজের সমান টাকা আনলেও এজেন্সিগুলোকে কম দেন। এসব কারণে অনিয়মের সুযোগ বেশি হয়।
হজ এজেন্সিগুলোর সংগঠন হাব। কিন্তু কোনো এজেন্সির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা সংগঠনটির নেই। হাবের মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, কিছু এজেন্সি মালিকের অনিয়ম ও প্রতারণার কারণে হজসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সুন্দর ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় হজ নিশ্চিত করতে হজ ব্যবস্থাপনাকে সুনির্দিষ্ট আইনের আওতায় আনতে হবে।

চূড়ান্ত হয়নি খসড়া হজ আইন
হজ কার্যক্রম পরিচালনা করতে ২০১২ সালে হজ আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়। ২০১৩ সালে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলেও তা অনুমোদন পায়নি। আইনটি সংশোধন করে মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু গত ছয় বছরেও সেটি সংশোধন করা হয়নি। ফলে জাতীয় হজ ও ওমরাহ নীতির ওপর ভিত্তি করে চলছে হজের কার্যক্রম।
হজ নীতিতে অনিয়ম, প্রতারণা ও মানব পাচার করলে এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল, জামানত বাজেয়াপ্ত, জরিমানার মতো শাস্তির বিধান রাখা হলেও এজেন্সি মালিকের শাস্তির কোনো বিধান রাখা হয়নি।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হজ আইনের খসড়া আবার প্রস্তুত করা হচ্ছে। নতুন খসড়ায় আগেরটি থেকে কিছু অংশ নেওয়া হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করে বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘আশা করছি আগামী বছরের হজ ব্যবস্থাপনা হজ আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।’
হজ আইন না থাকায় প্রতিবছর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিজেদের সুবিধামতো নীতিমালায় বিভিন্ন শর্ত সংযোজন ও বিয়োজন করেন। যেমন ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত হজ নীতিমালায় ৩৫ জনকে প্রশাসনিক দলের সদস্য করে সৌদি আরবে পাঠানোর কথা উল্লেখ ছিল। ২০১৭ সালে নীতিমালা সংশোধন করে সেটি ৪৫ জন করা হয়। কিন্তু নীতিমালা লঙ্ঘন করে ২০১৭ সালে প্রশাসনিক দলের সদস্য হিসেবে সৌদি আরব গিয়েছিলেন ৫৪ জন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আইন না হওয়ায় অনিয়ম বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এই অনিয়মের সঙ্গে সরকারের কোনো মহল জড়িত কি না, তাও দেখতে হবে। হজে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা না থাকা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধীরা কোনো না কোনোভাবে দায়মুক্তি সুবিধা পায়। ফলে তারা পুনরায় অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে।