ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ঘুরেফিরে সেই ৫৭ ধারা

>• আপত্তির মুখে সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া।
• সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বিলটিতে আপত্তি জানিয়েছে।
• বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।


তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করে সেই ধারার বিষয়বস্তুগুলো ঘুরেফিরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাখা হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়ার পর এটি ঘিরে বিতর্ক ও সমালোচনা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আপত্তি ওঠা কিছু ধারা বাদ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল।

কিন্তু গতকাল সোমবার জাতীয় সংসদে আইনটি উত্থাপনের পর দেখা যায়, তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এমনকি ‘ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি’-বিষয়ক ৩২ ধারার মতো আরও কঠিন একটি ধারা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বিলটিতে আপত্তি জানিয়েছে। পরে বিলটি চার সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বা তাঁদের প্রতিনিধিরাও আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, দেশে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ও ইউনিয়ন আইনটির কঠোর ও বিতর্কিত কিছু ধারা বাদ দেওয়ার দাবি তোলে। এসব দাবি আমলে না নিয়ে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া খসড়াটিই প্রায় হুবহু গতকাল জাতীয় সংসদে বিল আকারে উপস্থাপন করা হয়।

বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, বিলটি সংসদীয় কমিটিতে গেলে পর্যালোচনা করে সংযোজন-বিয়োজন করার সুযোগ থাকবে। কোনো উপধারা যুক্ত করতে হলে সেটিও স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে সংযোজন সম্ভব হবে।

আইসিটি আইনটি প্রথম করা হয় ২০০৬ সালে। পরে ২০১৩ সালে শাস্তি বাড়িয়ে সেটিকে আরও কঠোর করা হয়। কিন্তু ওই আইনের ৫৭ ধারায় সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ হয়রানির শিকার হন। নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব), বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের সব সংগঠন একযোগে ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি তোলে। পরে সরকারের পক্ষ থেকে ধারাটি বাতিলের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু গতকাল জাতীয় সংসদে যে বিল উত্থাপন করা হয়েছে, তাতে অপব্যবহারের সুযোগসহ এই আইন আরও কঠিন হিসেবে আসছে।

সংসদে বিলটির ওপর আপত্তি জানান জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম। তিনি বলেন, তথ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা পরিবর্তন হবে। আসলে তা হয়নি। সবই নতুন আইনে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৩২ ধারা। তিনি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর একটি লেখা এবং সম্পাদক পরিষদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ৩২ ধারার কারণে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। এটি হবে একটি বৈরী আইন। এই আইনে পায়ে বেড়ি দেওয়া হয়েছে। এক পা-ও সামনে আগানো যাবে না। ফখরুল ইমাম বিলটি উত্থাপন না করে আইনমন্ত্রীর আগের বক্তব্য অনুযায়ী ৩২ ধারার একটি ‘সেফটি ক্লজ’ যুক্ত করে তারপর এটি সংসদে তোলার দাবি জানান। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের রক্ষায় এই বিধান যুক্ত করা দরকার।

ফখরুল ইমাম আরও বলেন, সংবিধানে বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ করতে গিয়ে কাউকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। জামিন-অযোগ্য ধারা রাখার সমালোচনা করে তিনি বলেন, এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল। এই আইনে শুধু জেলের কথা আছে। আর কোনো কথা নেই। মানুষ পকেটে মোবাইল ফোন রেখে যেকোনো সময় হয়রানির শিকার হতে পারে।

যেসব ধারা নিয়ে বিতর্ক
প্রস্তাবিত আইনে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে গুপ্তচরবৃত্তি, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রচারণার মতো বিভিন্ন অপরাধ ও এর সাজা নির্ধারণ করা হয়েছে।

শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরে বসে কেউ এই আইনের অধীনে এমন অপরাধ করলে এই আইনে বিচার করার বিধান রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ হবে অজামিনযোগ্য।

প্রস্তাবিত আইনে ৩২ ধারায় ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। আবার এই অপরাধ অজামিনযোগ্য। এই ধারাটি নিয়েই সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে।

আইনে ২৯ ধারায় মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও সম্প্রচারের বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানি-সংক্রান্ত দণ্ডবিধির (১৮৬০) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড। আবার অপরাধটি দ্বিতীয় বা বারবার করলে অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।

আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে তা অপরাধ হবে। এ অপরাধের শাস্তি ১৪ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। আর বারবার করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে তা হবে একটি অপরাধ। এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই ধারার অপরাধে জামিন হবে না।

আইনের ৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, যদি কেউ বাংলাদেশের বাইরে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করেন, যা বাংলাদেশে সংঘটন করলে এই আইনের অধীনে দণ্ডযোগ্য হতো, তাহলে এই আইনের বিধানাবলি এইভাবে প্রযোজ্য হবে, যেন ওই অপরাধ তিনি বাংলাদেশেই সংঘটন করেছেন।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই আইনের খসড়াটি নিয়ে যখন সমালোচনা হয়েছিল, তখনো মনে হয়েছিল সরকার এসব সমালোচনা কর্ণপাত করবে না এবং সাংবাদিক ও বাক্স্বাধীনতার ওপর খড়্গ হিসেবে এই আইন সরকার ব্যবহার করবে। এখন বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধন বা বাদ দেওয়ার আন্দোলন আমাদের সবাইকে একসঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে।’