হাইক্কার খালের এক অংশে নীরব দখল

হাইক্কা খালের রায়েরবাজার অংশ। দখলের কারণে সংকুচিত। ক্ষীণ হয়ে আসছে এর ধারা। বেড়িবাঁধের ওপর থেকে খালের দৃশ্য।  ছবি: প্রথম আলো
হাইক্কা খালের রায়েরবাজার অংশ। দখলের কারণে সংকুচিত। ক্ষীণ হয়ে আসছে এর ধারা। বেড়িবাঁধের ওপর থেকে খালের দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো
>
  • চার বছর আগে ২০ কোটি টাকায় সংস্কার
  • দুই ঘাটের একটি দখলদারের মাটির নিচে
  • এক পাড়ে এখনো ১০ ফুট চওড়া হাঁটার পথ আছে

খালের এক তীর ঘেঁষে প্রতিদিন ফেলা হচ্ছে আবর্জনা। আবর্জনা কিছুটা জমলে তার ওপর ফেলা হচ্ছে মাটি। সে মাটিতে লাগানো হচ্ছে বড় বড় গাছ। পাশে তৈরি করা হচ্ছে থাকার ঘর, দোকান। আবার কোথাও খালের ভেতরে বাঁশের বেড়া দিয়ে দখলদারি আরও বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। 

খাল দখলের নিরবচ্ছিন্ন এই কৌশল দেখা যাবে রায়েরবাজারের হাইক্কার খালে। বুড়িগঙ্গা নদীর শাখা হিসেবে পরিচিত খালটি। মাত্র চার বছর আগে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে খালটি খনন করেছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তখন উচ্ছেদ করা হয়েছিল সব অবৈধ স্থাপনা।

প্রকল্পের আওতায় দুই পাড়ের মানুষের যাতায়াতের সুবিধার জন্য যে দুটি পাকা নৌঘাট তৈরি করা হয়েছিল, তার একটি এখন দখলদারের মাটির নিচে চাপা পড়ে গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দখলি জায়গায় থাকা দোকানদার আর স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালটির রায়েরবাজার অংশের একক দখলদার ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান। কিন্তু সাদেক খান দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘খাল দখলের কথা আমি চিন্তাই করতে পারি না।’

প্রথমে আবর্জনা, তারপর মাটি, তার ওপর গাছ আর ছাপরা ঘর—এই হলো খাল দখলের প্রক্রিয়া
প্রথমে আবর্জনা, তারপর মাটি, তার ওপর গাছ আর ছাপরা ঘর—এই হলো খাল দখলের প্রক্রিয়া

রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধসংলগ্ন হাইক্কার খালের অবস্থান বেড়িবাঁধের প্রায় আধা কিলোমিটার পশ্চিমে। শহীদ স্মৃতি সেতুর কাছে বুড়িগঙ্গা নদীর মূলধারা থেকে রায়েরবাজার বধ্যভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত খালটি। দখল-দূষণের কারণে মরতে বসা এই খাল বাঁচানোর জন্য ২০১০ সালে নতুন করে সীমানা নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসন। পরে এটি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

ভরাট করে ফেলা সাদেক খান ঘাট।
ভরাট করে ফেলা সাদেক খান ঘাট।

খালটি বুঝে নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ২০১১ সালে জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ‘রায়েরবাজার-সংলগ্ন হাইক্কার খালে সঞ্চিত বর্জ্য অপসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। তিন বছর এ কার্যক্রম চলে। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, ওই সময়ে প্রকল্পের আওতায় খালটি ১৩ ফুট পর্যন্ত গভীর, ১০০ ফুট চওড়া এবং এক পাড়ে ১০ ফুট চওড়া হাঁটার পথ তৈরি করা হয়। এ ছাড়া রায়েরবাজার থেকে বছিলা অংশে সহজে যাতায়াতের জন্য খালের দুই পাড়ে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয় দুটি ঘাট।

সম্প্রতি বেড়িবাঁধের ওপর রায়েরবাজার স্লুইসগেটের মুখে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, শুরুর অংশে খালটি মোটামুটি চওড়া থাকলেও খানিক পর থেকে খালের ডান পাড়ে ছয়টি সারিতে শতাধিক টিনের ঘর। ওই অংশে আবর্জনা ফেলে ফেলে খাল দখল করা হয়েছে। আরও খানিকটা সামনে খালটি একেবারেই সরু হয়ে প্রায় নালার রূপ নিয়েছে।

এর পরে বেড়িবাঁধ থেকে পশ্চিমে ঘাটের দিকে যেতে রাস্তার দুই পাশে অন্তত ১৫টি ইট-বালু বিক্রির দোকান চোখে পড়ে। তবে এগুলোর কোনোটার অবস্থান খালপাড়ে নয়। কিন্তু রাস্তার মাঝামাঝি জায়গায় বাঁ পাশে দেখা গেল, প্রায় অর্ধেক খাল ভরাট করে সেই জায়গায় তৈরি করা হয়েছে দুটি ঘর। ঘরের চারপাশে কয়েকটি নারকেলগাছের বড় বড় চারা লাগানো।

আরও খানিক পথ এগিয়ে গিয়ে তেখা গেল, চার বছর আগে তৈরি করা রায়েরবাজার অংশের ঘাটটি পুরোপুরি ঢেকে ফেলা হয়েছে ইটের সুরকি দিয়ে। অপর পাড়ে বছিলা অংশের ঘাটটি ঠিক আছে। তবে এ পাড়ে ঘাটের ডান দিকে খালের ভেতর অন্তত ১০ হাত লম্বা বাঁশের বেড়া দেওয়া। আর আগে থেকেই ভরাট করা অংশে গাছ লাগানো।

স্থানীয় লোকেরা জানান, বর্ষা মৌসুমে এই দুটি ঘাটই সচল থাকত। ঘাট বন্ধ করে দেওয়ায় বছিলা থেকে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত সহজ রাস্তাটিও বন্ধ হয়ে গেল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বছিলা ও রায়েরবাজার এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানান, এই দখলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা সাদেক খান জড়িত। সরাসরি তদারক করেন তাঁর ব্যবস্থাপক বা ম্যানেজার। মজার ব্যাপার হলো, এই ঘাটটি সাদেক খানের ঘাট নামে পরিচিত।

এ বিষয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী ও খাল খননের সময় প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে থাকা মো. মহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, আর্থিক সংকটের কারণে খননের পর খালটি আর রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। এখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে যতটুকু জানি, খালের কিছু অংশ আবার দখল হয়েছে। ময়লা-আবর্জনাও বেড়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি দল গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। যদি এমন কিছু ঘটে তাহলে অবশ্যই প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কিন্তু যাঁর বিরুদ্ধে খাল দখলের অভিযোগ, সেই সাদেক খান তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘খাল তো ঠিকই আছে। খুব সুন্দর আছে। ভালো
অবস্থানে আছে। এখন সংস্কার করার দরকার কি। আর ঘাট তো ছিলই না।’ তিনি বলেন, ‘আমার দিক থেকে এ রকম কিছু করা হয়নি। এইটা আমি চিন্তাও করতে পারি না।’

শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান–সংলগ্ন হাইক্কার খালের ভেতরের অংশে বাঁশের বেড়া দিয়ে দখল।
শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান–সংলগ্ন হাইক্কার খালের ভেতরের অংশে বাঁশের বেড়া দিয়ে দখল।

কিন্তু গত মার্চ মাসে বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলীর কাছে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে। একটু দেরি হবে। সর্বশেষ ৪ এপ্রিল তিনি জানান, কোনো প্রতিবেদন তৈরি হয়নি। মৌখিকভাবে বিআইডব্লিউটিএর দুই কর্মকর্তা তাঁকে খালের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেছেন। তাঁদের বর্ণনামতে, ঘাটের একটা অংশ ভরাট করা হয়েছে। কিন্তু অন্য অংশগুলো মোটামুটি ঠিক আছে। আর যাতে ভরাট করা না হয় সে ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ কারা ‘ঘাট’ ভরাট করেছে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো বলতে পারব না।’ তাহলে খাল ভরাট না করার জন্য কাদের নির্দেশ দিলেন-এর জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমি আপনার অনেক প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছি। সরকারি চাকরি করি। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। চাইলেও সব কথা বলতে পারি না। আপনি বুঝে নেন।’