ইলিশের পথ আটকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঢল

একসময় সুস্বাদু ইলিশ বেশি পাওয়া যেত চাঁদপুরে। পদ্মা ও মেঘনার এই মিলনস্থলে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরতেন জেলেরা। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় আর দূষণের দাপটে সেখান থেকে ইলিশের দল পালিয়েছে। আশ্রয় নিয়েছে ভোলা-নোয়াখালী হয়ে পটুয়াখালী উপকূলে। এখন ইলিশের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল পটুয়াখালী উপকূলের আন্ধারমানিক, পায়রা, বামনাবাদ ও নোয়াখালী নদী।

কিন্তু ওই অঞ্চল ঘিরে বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় ইলিশের বসতি আবারও ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। শুধু কলাপাড়া উপজেলাতেই সরকার ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র, একটি সমুদ্রবন্দর, বিশেষ শিল্পাঞ্চল ও চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রকল্প নির্মিত হলে ওই অঞ্চলের নদীগুলো হবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পানির জোগানদাতা এবং গরম পানি ও বর্জ্য ফেলার স্থান। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাঁচামাল আনতে নদীগুলো খনন করা হবে। ফলে ওই পথে জাহাজ চলাচল বাড়বে। এতে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা ইলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রবেশপথ আটকে যাবে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইআইইডি) গবেষণায় বলা হয়েছে, কলাপাড়া-কুয়াকাটা বাংলাদেশের ইলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলন, বিচরণ ও পালনকেন্দ্র। জাটকা থেকে পরিণত হওয়ার আগে ইলিশের দল বসত গড়ে আন্ধারমানিক নদে। সেখানে একটু পরিণত হয়ে বা বড় হয়ে তারা সমুদ্রে ফিরে যায়। দূষণ না থাকায় ওই এলাকায় ইলিশের খাবারের জোগানও বেশি।

নদী সংরক্ষণ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার কিপারস বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চলতি মাসে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অন্যান্য স্থাপনার প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। গবেষণায় কলাপাড়া ও কুয়াকাটার ভূমির গঠন এতগুলো শিল্পকারখানাকে ধারণ করতে পারবে কি না, প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রতিবছর ওই এলাকায় প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ইলিশের বাণিজ্য হয় উল্লেখ করে সংস্থাটির বাংলাদেশ শাখার সমন্বয়কারী শরীফ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ইলিশ উৎপাদনে গত এক যুগের সফলতায় ছেদ ফেলবে। ইলিশের দল অন্যত্র পালাতে বাধ্য হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় কলাপাড়াকে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান অঞ্চল বা ‘পাওয়ার হাব’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেই লক্ষ্যে সরকার বরিশাল থেকে কলাপাড়া পর্যন্ত চারটি সেতু নির্মাণ করেছে। বরিশাল-কুয়াকাটা সড়ক চার লেনে পরিণত হয়েছে। একটি বিমানবন্দর, বাণিজ্যিক এলাকাসহ আরও কিছু স্থাপনা তৈরি হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, কলাপাড়ায় যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ হচ্ছে, সেগুলোর প্রতিটির জন্য আলাদা পরিবেশগত সমীক্ষা করা হচ্ছে। তবে সামগ্রিকভাবে ওই এলাকার ওপর কোনো কৌশলগত প্রভাব সমীক্ষা (এসইএ) হয়নি। দেশের বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে কোনো পরামর্শ দেননি।

কলাপাড়া উপজেলা পরিষদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্প ও শিল্পকারখানা এবং অবকাঠামোর জন্য কলাপাড়ায় প্রায় ৩০ হাজার একর জমি দরকার হবে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৫ হাজার একর অধিগ্রহণ করে বিভিন্ন কোম্পানিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। পায়রাবন্দর ও দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব প্রথম আলোকে বলেন, বিগত এক যুগে সরকারের নেওয়া উদ্যোগে দেশের ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। আর কলাপাড়া এলাকার নদীগুলো দেশের তো বটেই, পৃথিবীর ইলিশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লালন ও বিচরণ এলাকা। ওই এলাকায় এতগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র একসঙ্গে নির্মাণ করলে তা দেশের এই অমূল্য সম্পদ ইলিশের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।

কারা কী নির্মাণ করছে
নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি জার্মানির সিমেন্সের সঙ্গে ৩ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট এবং চীনের সিএমসি কোম্পানির সঙ্গে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের দুটি, ১০০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুতের একটি ও বায়ুচালিত ৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। এ ছাড়া আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি ও চীন যৌথভাবে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে।

এর বাইরে ওই এলাকায় পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ইনডেক্স গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানি ওই এলাকায় জমি কিনেছে। তারাও সেখানে এলপিজি গ্রামসহ নানা ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে।

মাটি-পানি ও ইলিশের ঝুঁকি
রাষ্ট্রীয় কোম্পানি নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও চীন যৌথভাবে কলাপাড়ায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ প্রায় ৩৫ শতাংশ শেষ করে এনেছে। ওই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৮ লাখ টন কয়লা পোড়ানো হবে। সেখানে প্রতিদিন তৈরি হবে প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন ছাই। প্রতিদিন বামনাবাদ নদ থেকে ৪ হাজার ২০০ ঘনমিটার পানি উত্তোলন করা হবে, যার ব্যবহারের পর উত্তপ্ত অবস্থায় আবারও ওই নদে ফেলা হবে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) তত্ত্বাবধানে সমীক্ষাটি হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কেবল ওই একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ইলিশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য বামনাবাদ, আন্ধারমানিক ও টিয়াখালী নদীর পানি ও মাটিদূষণ মাঝারি থেকে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ওই এলাকায় পানি নিষ্কাশনব্যবস্থাও উচ্চ ঝুঁকিতে পড়বে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক আনিসুর রহমান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, কলাপাড়া এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ যেসব অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে, তার প্রভাব অবশ্যই ইলিশের ওপর পড়বে। ইলিশ খুব দূষণ সংবেদনশীল প্রাণী।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, দেশের উন্নয়ন ও চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ প্রয়োজন। দেশের জন্য আরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে কোথাও না কোথাও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে দেশের পরিবেশ, প্রকৃতি ও খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করাও সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কোনো একটি এলাকায় অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা আলাদাভাবে হয়তো বড় ধরনের দূষণ করবে না। কিন্তু এগুলো সম্মিলিতভাবে বড় ধরনের দূষণ ও বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। আইনুন নিশাত মনে করেন, পরিবেশ আইন মেনে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও প্রকল্পের জন্য আলাদা সমীক্ষা করা হলেও সম্মিলিত প্রভাব ও ঝুঁকি নিরূপণ করা প্রয়োজন।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন পটুয়াখালীর কলাপাড়া প্রতিনিধি নেছারউদ্দিন আহমেদ