পাঁচ লাখ পেশাদার নির্মাণশ্রমিক তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার

বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশিক্ষিত নির্মাণকর্মী চায়। ফাইল ছবি
বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশিক্ষিত নির্মাণকর্মী চায়। ফাইল ছবি

পেশাদার নির্মাণশ্রমিক তৈরি করতে সরকার বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরে পাঁচ লাখ পেশাদার নির্মাণশ্রমিক তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এরই মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গেছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব পেয়েছে হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই)। সরকারের গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান রাজধানীর কল্যাণপুরে।

প্রকল্পের বিষয়ে কথা হয় প্রকল্পটির সমন্বয়ক ও এইচবিআরআইয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক আকতার হোসেন সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি। প্রাথমিক পর্যায়ে এখন ট্রেনিং ফর ট্রেইনার (টট) কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে গণপূর্ত, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ এখানে দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা এই প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। এই প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা যে জ্ঞান অর্জন করবেন, তা সাধারণ শ্রমিকদের শেখাবেন।

পরে নির্মাণশ্রমিকদের একটি সনদপত্র দেওয়া হবে। সেই সনদ তাঁরা দেশে-বিদেশে দেখাতে পারবেন। এটি দেখালে শ্রমিকের পেশাগত দক্ষতা প্রকাশ পাবে, যা তাঁদের পারিশ্রমিক বাড়াতে সহায়তা করবে বলে মনে করেন আকতার হোসেন।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমে ৩৮৪ জন প্রকৌশলীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রতি জেলায় দুজন প্রকৌশলী ও চারজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এই প্রকৌশলীরা ৬৪ জেলায় মাঠপর্যায়ে আগামী পাঁচ বছরে নির্মাণশ্রমিকদের ১২টি আলাদা আলাদা ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেবেন। এই প্রকল্পের জন্য সরকারের কাছে তিন হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাঠিয়েছে এইচবিআরআই। প্রতি ব্যাচে ২০ জন শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। হাতেকলমে তাঁরা শিখবেন মোট ৬০ দিন। প্রশিক্ষণের সময় শ্রমিকেরা প্রতিদিন খাওয়া ছাড়াও যাতায়াতের জন্য ভাতা পাবেন।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ কোটি ৪১ লাখ শ্রমিক দেশের বাইরে কাজের জন্য গেছেন। গত মার্চ মাসেই গেছেন ৬২ হাজার শ্রমিক। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর পাঁচ থেকে ছয় লাখ লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে বিদেশে।

প্রতি মাসে শ্রমিকের চাহিদা কেমন, তা জানতে চাইলে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর এক কর্মকর্তা জানান, এটি বিভিন্ন দেশের চাহিদার ওপর নির্ভর করে। কোনো সময় সৌদি আরবে শ্রমিকের চাহিদা বেড়ে যায়। আবার কোনো সময় মালয়েশিয়াতে শ্রমিকের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই এই তথ্য নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

প্রতিবছর ঢাকায় ও দেশের বাইরে অনেক নির্মাণশ্রমিক দরকার হয়। এ জন্য এই ধরনের প্রশিক্ষণ সরকারের একটি ভালো পদক্ষেপ বলে মনে করেন শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেন—এমন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রশিক্ষণের ফলে পেশাদার শ্রমিক তৈরি হবে। তবে নিরাপত্তার বিষয়েও তাঁদের প্রশিক্ষণের প্রতি গুরুত্ব দেন তিনি। নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক শ্রমিক প্রতিদিন মারা যান বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিলসের দেওয়া তথ্য অনুসারে, কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মারা যান পরিবহন-সংশ্লিষ্ট শ্রমিকেরা। এরপরই রয়েছে নির্মাণশ্রমিকদের অবস্থান। গত বছরে কাজ করতে গিয়ে ১৩৪ জন নির্মাণশ্রমিক মারা গেছেন। প্রশিক্ষণ পেলে এই হার কমে আসবে বলে জানালেন সুলতান উদ্দিন আহম্মদ।

বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আল ইসলাম ওভারসিজ। কয়েক বছর ধরে সরকারের সঙ্গে যৌথ চুক্তির মাধ্যমে তাঁরা কাতারে নির্মাণশ্রমিক পাঠানোর কাজ করে আসছে। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জয়নাল আবেদিন জাফর বলেন, ‘বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশিক্ষিত নির্মাণকর্মী চায়। প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা বেশ কয়েকবার সরকারিভাবে শ্রমিক পাঠানোর কাজ করেছি। এখন সরকার যদি নিজেই প্রশিক্ষিত নির্মাণশ্রমিক তৈরি করে, তাহলে আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ অনেক সহজ হবে। এতে দেশে যেমন দক্ষ শ্রমিক বাড়বে, তেমনি তাঁদের বিদেশেও কদর বাড়বে।’

এইচবিআরআই পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এইচবিআরইয়ের মাধ্যমে পাঁচ লাখ নির্মাণশ্রমিক প্রশিক্ষণ পেলে আমরা প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের বড় একটি অংশকে বিদেশের বাজারে পাঠাতে পারব। এতে বৈদেশিক অর্থ আরও সমৃদ্ধ হবে। পাশাপাশি দেশের নির্মাণ খাতও শক্তিশালী হবে।’