আয় নিয়ে বাগ্যুদ্ধে খালেক-মঞ্জু

তালুকদার আবদুল খালেক ও নজরুল ইসলাম মঞ্জু
তালুকদার আবদুল খালেক ও নজরুল ইসলাম মঞ্জু

নির্বাচনী হলফনামায় নিজ পেশা ও ব্যবসার তথ্য গোপন করেছেন তালুকদার আবদুল খালেক—এ অভিযোগ নজরুল ইসলাম মঞ্জুর। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তালুকদার আবদুল খালেক আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী। নজরুল ইসলাম মঞ্জু বিএনপির।

মঞ্জুর এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তালুকদার আবদুল খালেকের পাল্টা অভিযোগ, মঞ্জু হলফনামায় তাঁর বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন মাত্র দুই লাখ টাকা। সে হিসাবে মাসিক আয় হয় ১৬ হাজার ৬৬৭ টাকা; যা একজন রিকশাচালকের আয়ের চেয়েও কম। মঞ্জুর দেড় কোটি টাকার গাড়িটি কি বাতাসে চলে?

খুলনার সিটি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়নি। এর আগেই দুই প্রধান দলের মেয়র প্রার্থীরা মেতে উঠেছেন বাগ্‌বিতণ্ডায়। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ করছেন একে অন্যের বিরুদ্ধে। রিটার্নিং কর্মকর্তার পাশাপাশি সংবাদকর্মীদের কাছেও এসব অভিযোগ তুলে ধরছেন প্রার্থীরা। এ সিটির নির্বাচন হবে ১৫ মে। ১২ এপ্রিল ছিল মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন।

মনোনয়নপত্র যাচাই–বাছাইয়ের দিন কোনো অভিযোগ না করলেও পরদিন রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ওই দিন রাতেই গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বিএনপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ আনেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী। একই বিষয় নিয়ে পরদিন মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে দলটি। আবার বিকেলে ওই বিবৃতিকে আচরণবিধি লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছে বিএনপি।

গত সোমবার দুপুরে নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও খুলনার জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরের কাছে তালুকদার আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে হলফনামায় তথ্য গোপনের লিখিত অভিযোগ করেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। তাঁর অভিযোগ, তালুকদার খালেক সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, নওয়াপাড়া-ফকিরহাটের ইস্টার্ন পলিমার লিমিটেডের পরিচালক। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেন। ইস্টার্ন পলিমারের ঋণ তথ্যও তাঁর হলফনামায় উল্লেখ করেননি। মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক হলফনামায় নিজ পেশা ও ব্যবসার তথ্য গোপন করেছেন।

বিষয়টি তদন্ত করে তাঁর মনোনয়ন বাতিল করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয় বিএনপির পক্ষ থেকে।

এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ইউনুচ আলী সোমবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সময় উপস্থিত সব প্রার্থী ও তাঁদের এজেন্টরা কোনো আপত্তি দেননি। ফলে আমরা মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তালুকদার আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির পক্ষ থেকে আমার নামে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, সেগুলো সবই মিথ্যা। আমার হলফনামায় কোনো মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়নি। শুধু মিথ্যা তথ্য দিয়ে তারা কেন আমার বিরুদ্ধে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করল? তাঁর নিজের হলফনামায় দেওয়া তথ্যেরও সমস্যা আছে।’

বিএনপির এ অভিযোগের পর সোমবার রাতেই আওয়ামী লীগের নেতারা এক বিবৃতির মাধ্যমে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বিরুদ্ধে হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ তুলে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিলের দাবি জানান।

সেখানে মঞ্জু হলফনামায় দেখানো দুই লাখ টাকা আয়ের হিসাবের সমালোচনা করে বলা হয়, এ আয় একজন রিকশাচালকের আয়ের চেয়েও কম। বিবৃতিতে বলা হয়, নজরুল ইসলাম মঞ্জু বাস করেন একটি আলিশান ভাড়া বাড়িতে। যে বাড়ির মাসিক ভাড়া কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা। তাহলে তিনি কি বাড়িওয়ালাকে জিম্মি করে অথবা বিনা অর্থে বসবাস করেন?

দলটির নেতারা আরও বলেন, একটি পরিবারে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, খাওয়াসহ মাসে কমপক্ষে খরচ ৩০ হাজার টাকা। হলফনামার তথ্য মেনে নিলে সাধারণ মানুষের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর অর্থের উৎস কোথায়?

ওই বিবৃতি দেন কেন্দ্রীয় নেতা বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, কেন্দ্রীয় নেতা এস এম কামাল হোসেন, খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক বিরোধীদলীয় হুইপ এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা, মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও ১৪ দলের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান মিজানসহ বিভিন্ন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা।

মঙ্গলবার দুপুরে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে একই অভিযোগ তোলেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

এ প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম মঞ্জু প্রথম আলোকে বলেন, ‘তালুকদার সাহেবের হলফনামার বিষয়ে আমরা যে অভিযোগ করেছি, ওই সব তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। এখন তাঁরা সেটা ভুল প্রমাণ করুন। আমার হলফনামা নিয়ে যা বলা হচ্ছে, সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। আমার নিজের কোনো সম্পদ নেই। শুধু শুধু চরিত্রহননের চেষ্টা কেন?’

ওই সংবাদ সম্মেলনের কিছুক্ষণ পরেই বিএনপি প্রার্থী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে তালুকদার আবদুল খালেক নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ করে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানান। খুলনা ২, ৩ ও ৪ আসনের সাংসদদের নাম উল্লেখ করে আবেদনে বলা হয়, সাংসদেরা তাঁদের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে এবং বিএনপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে অসত্য, কুৎসামূলক, বেআইনি ও উসকানিমূলক বিবৃতি দিয়ে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন।

এর বাইরেও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দুই দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে নানা রকম কথার যুদ্ধ চলছে। প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা–সমালোচনার পাশাপাশি নির্বাচনকালীন কর্মকর্তাদের নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। খোদ নগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মুনশি মাহবুব আলম দুজন নির্বাচনী কর্মকর্তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে এ ধরনের বাগ্‌যুদ্ধ এবং অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ নির্বাচনী পরিবেশে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, নির্বাচনে কথার লড়াই অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। কিন্তু তথ্য গোপনের অভিযোগ করার মাধ্যমে কেউ যদি কারও চরিত্রহননের চেষ্টা করেন, তাহলে সেটা কিছুটা সমস্যা তৈরি করতে পারে।