নারায়ণগঞ্জে গ্যাসবোমার ওপর বসবাস তাঁদের

>

• অভিনব কায়দায় গ্যাস সংরক্ষণ
• পলিথিনের মধ্যে গ্যাস জমিয়ে তা রান্নার কাজে ব্যবহার করেন গ্রামের অনেকেই
• পুরো প্রক্রিয়াটিই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ 
• কিন্তু দেখার কেউ নেই

দূর থেকেই চোখে পড়ে মোটা লাল, নীল, হলুদসহ বিভিন্ন রঙের বড় লম্বাটে পলিথিন (বিশাল আকৃতির লম্বাটে বেলুনের মতো দেখতে)। বেলুন আকৃতির পলিথিনগুলো টিনের চাল বা গাছের ওপরে ঝুলছে, বিশেষ কায়দায় রশি দিয়ে বাঁধা। পলিথিনের ভেতরে প্লাস্টিকের পাইপ ঢোকানো। এ পাইপ বিদ্যুতের লাইন ও গ্যাসের চুলার সঙ্গে যুক্ত করা। বেলুনগুলো গ্যাসে ভর্তি। রান্নার কাজে লাগানো হয় বেলুনের এ গ্যাস।

স্থানীয়ভাবে বেলুন বা পলিথিনে গ্যাস সংরক্ষণের এ পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফুটকা’। এ গ্যাস ব্যবহারের শর্ত হলো বিদ্যুৎ থাকতে হবে। গ্যাসের
চুলার চাবি ও বিদ্যুতের লাইন চালু করে ম্যাচ ঘষলে মিলবে গ্যাস। ঘরের মধ্যেও অনেকে লাগিয়েছেন এ ফুটকা।

গত এক সপ্তাহে দুই দফায় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের বালিয়াপাড়ায় গিয়ে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। এলাকার প্রায় বাড়িতেই লাগানো হয়েছে এ বেলুন। বেলুনে গ্যাস ভর্তির জন্য ছোট কমপ্রেশারসহ আরও কিছু যন্ত্রপাতি লাগে। সব মিলে খরচ তিন থেকে ছয় হাজার টাকা।

পলিথিন পাল্টে বারবার এ পদ্ধতিতে গ্যাস সংরক্ষণ করা যায় বলে জানালেন এলাকাবাসী। তবে গ্যাস সংরক্ষণের জন্য লাইনে গ্যাসের চাপ থাকতে হয়। গ্যাসের চাপ থাকে রাত তিন-চারটার দিকে। এলাকাবাসী রাত জেগে তখন পরের দিনের রান্নার গ্যাস সংরক্ষণ করেন।

বালিয়াপাড়া গ্রামের আবুল কাসেম জানালেন, গ্যাসের লাইনের সঙ্গে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে পলিথিনের মধ্যে সংযোগ দেওয়া হয়। কমপ্রেশার ব্যবহার করে গ্যাসের চুলায় রান্না করা হয়।

প্রায় সব বাড়িতেই অবৈধ গ্যাসের সংযোগ। দু–তিন দিন পর গ্যাস আসে বলে অনেকেই প্লাস্টিকের বেলুনে মজুত করে রাখছেন গ্যাস। যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। গত শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার ব্রাহ্মণদী ইউনিয়নের ভাটিগোপিন্দি গ্রামে।  ছবি: সাইফুল ইসলাম
প্রায় সব বাড়িতেই অবৈধ গ্যাসের সংযোগ। দু–তিন দিন পর গ্যাস আসে বলে অনেকেই প্লাস্টিকের বেলুনে মজুত করে রাখছেন গ্যাস। যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। গত শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার ব্রাহ্মণদী ইউনিয়নের ভাটিগোপিন্দি গ্রামে। ছবি: সাইফুল ইসলাম

গ্যাস সংরক্ষণের পদ্ধতিটি অভিনব হলেও বেলুনে গ্যাস সংরক্ষণ করার গ্যাসের লাইনটি অবৈধ বলে জানিয়েছেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, অবৈধ লাইন থেকে যে পদ্ধতিতে এলাকাবাসী গ্যাস সংরক্ষণ করছেন, তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

বালিয়াপাড়া গ্রামের নূরুল ইসলাম বলেন, বালিয়াপাড়া গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এভাবে পলিথিনের মধ্যে গ্যাস জমিয়ে তা রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। মাঝেমধ্যে অবৈধ গ্যাসলাইনের বিষয়ে খোঁজ নিতে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন আসেন। অভিযানের পর কিছু বাড়ি থেকে পলিথিন সরিয়ে ফেলা হয়। তবে পরে আবার লাগানো হয়।

তিতাসের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী এইচ এম আলী আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস সংরক্ষণের বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে পুরো প্রক্রিয়াটি বড় হুমকি বা ঝুঁকি তৈরি করেছে। আগুন লাগলে বা যেকোনো দুর্ঘটনায় পুরো এলাকায় বিস্ফোরণ হতে পারে। বলা যায়, এলাকাবাসী গ্যাসবোমার ওপরেই বসবাস করছে।

ঝুঁকি সম্পর্কে এলাকাবাসীও অবগত। কিন্তু গত দু-তিন মাস ধরে তাঁরা এ পদ্ধতিটি ব্যবহার করছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তাই অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছেন বলে তাঁরা জানালেন। একইভাবে আশপাশের ইউনিয়ন থেকেও অনেকে উৎসাহ দেখাচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, কয়েক বছর ধরে তাঁদের প্রায় সময়ই এক বেলা রান্না করে তা কয়েক বেলা খেতে হয়। আর গ্যাস ধরার জন্য এখন রাত জেগে বসে থাকতে হয়।

এলাকাবাসীর বক্তব্য, গ্যাস না পেয়েই তাঁরা বিকল্প এ ঝুঁকিপূর্ণ পথে পা বাড়াচ্ছেন। ফিরোজা নামের এক বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, তিন বছর আগে এলাকার চেয়ারম্যান ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রায় বাধ্য করেন অবৈধ গ্যাসের লাইন নেওয়ার জন্য। কিস্তিতে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে গ্যাসের লাইন নেন। এ গ্যাস দিয়ে রান্না করেন ১৩ দিন। তারপর থেকে গ্যাসের আর দেখা পাননি। গাছ কেটে লাকড়ি সংগ্রহ করে তিনি রান্নার কাজ চালাচ্ছেন। এখন তিনি একদিকে গাছ কাটছেন, অন্যদিকে কিস্তির টাকা পরিশোধ করছেন।

অবৈধভাবে গ্যাসলাইন ও বর্তমান বেলুন পদ্ধতিটি নিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, চেয়ারম্যান ও চেয়ারম্যানের সঙ্গী-সাথিরা উৎসাহিত করছেন বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লাক মিয়া। তিনি বলেন, ইউনিয়নে আবাসিক এলাকায় যে গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে, তা অবৈধ লাইন। তবে এলাকাবাসী কীভাবে এ গ্যাসলাইন নিয়েছেন তা তিনি জানেন না। এমনকি বেলুনে করে গ্যাস সংরক্ষণের বিষয়টিও তিনি জানেন না।

অনেকে ঘরের ভেতরেই ভরে রাখছেন প্লাস্টিকের ওই বেলুন।
অনেকে ঘরের ভেতরেই ভরে রাখছেন প্লাস্টিকের ওই বেলুন।

চেয়ারম্যান লাক মিয়ার দাবি, তিনি বাড়িতে তাঁর ফ্যাক্টরি থেকে গ্যাসের লাইনের সংযোগ নিয়েছেন। ফ্যাক্টরির জন্য যে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে 
তা যেহেতু বৈধ, তাই তাঁর বাড়িতে নেওয়া লাইনটিও বৈধ।

তবে তিতাসের সোনারগাঁও জোনাল ম্যানেজার আবদুল মোমেন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, আড়াইহাজার থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন, বিশেষ
করে ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের বালিয়াপাড়ায় আবাসিকে যেসব গ্যাসলাইন ব্যবহার করা হচ্ছে, তা পুরোপুরি অবৈধ।

নারায়ণগঞ্জের সাংসদ নজরুল ইসলাম টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পলিথিনে গ্যাস সংরক্ষণ করা হয় তা জীবনে প্রথম শুনলাম। আমার জানা থাকলে এ ধরনের কাজ হতে দিতাম না। তিতাস আইনগত পদক্ষেপ নিলে আমি সার্বিকভাবে সহযোগিতা করব।’

আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বালিয়াপাড়ায় পলিথিনে গ্যাস জমিয়ে রেখে পরে তা দিয়ে রান্না করে, এমন খবর আমার জানা নাই।’

দিনের পর দিন ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের এলাকাবাসী কীভাবে অবৈধ লাইন ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন, এ প্রশ্নে তিতাসের একাধিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের প্রভাব, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তদবির এবং এলাকাবাসীর অসহযোগিতার জন্য এসব এলাকার অবৈধ লাইন উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি এম মনিরুল ইসলাম