অন্য শহরে ঢাকার চেয়েও দূষিত বায়ু!

ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর একটি। কিন্তু দেশের অন্য শহরগুলোর অবস্থা মোটেও ঢাকার চেয়ে ভালো নয়। বরং কিছু ক্ষেত্রে ঢাকার চেয়েও নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহীর বায়ুদূষণ পরিস্থিতি খারাপ। বায়ুদূষণ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, শুষ্ক মৌসুমে অন্য বিভাগীয় শহরগুলোর বাতাসে মানমাত্রায় চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ক্ষতিকর বস্তুকণা ভেসে বেড়ায়। মূলত নভেম্বর থেকে মার্চ-এই সময়ে ধূলিদূষণ হয় বেশি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন বলছে, ইটভাটা, সড়কের ধুলা ও মাটি, যানবাহনের ধোঁয়া এই অতিমাত্রায় দূষণের কারণ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ঢাকার তিনটি এলাকা (দারুসসালাম, ফার্মগেট ও সংসদ ভবন), চট্টগ্রামের দুটি এলাকা (টিভি স্টেশন ও আগ্রাবাদ) এবং গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশালে বাতাস পর্যবেক্ষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এ শহরগুলোয় বছরে ১০০ থেকে ১২০ দিন বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা পিএম-১০ (১০ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে ছোট ব্যাসের বস্তুকণা) ও পিএম-২.৫ (২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে ছোট ব্যাসের বস্তুকণা) দৈনিক সহনীয় মানমাত্রার চেয়ে বেশি থাকে।

বায়ুমান মনিটরিং স্টেশন (ক্যামস) নামক স্থায়ী ব্যবস্থা থেকে বছরজুড়ে বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এই ১১টি স্টেশন থেকে বায়ুতে পিএম-১০, পিএম-২.৫ ছাড়াও ওজোন, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড-এই ছয় প্রকার বায়ুদূষক পর্যবেক্ষণ করা হয়।

সম্প্রতি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। তাতে দেখা যায়, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ শহরসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে পিএম-১০ ও পিএম-২.৫-এর উপস্থিতি বার্ষিক গড় মানমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। তবে অন্য চারটি দূষক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে।

প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাতাসে ক্ষতিকর পিএম-১০-এর বার্ষিক গড় উপস্থিতি রাজধানীর ফার্মগেটে ১৩৬ দশমিক ৯১ মাইক্রোগ্রাম। অথচ এটির উপস্থিতি ফার্মগেটের চেয়ে বেশি নারায়ণগঞ্জ (২১২ দশমিক ২৯ মাইক্রোগ্রাম) ও রাজশাহীতে (১৪৭ দশমিক ৭০ মাইক্রোগ্রাম)। এ ছাড়া গাজীপুর (১৩৬ দশমিক ৬৯ মাইক্রোগ্রাম), বরিশাল (১৩২ দশমিক ১৪ মাইক্রোগ্রাম) ও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে (১২১ দশমিক ১২) পিএম-১০-এর উপস্থিতি ফার্মগেটের প্রায় কাছাকাছি।

ধুলায় বিপর্যস্ত জনজীবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
ধুলায় বিপর্যস্ত জনজীবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

উল্লেখ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুযায়ী, বাতাসে পিএম-১০ বা ১০ মাইক্রোগ্রাম আকারের বস্তুকণা দূষণের সহনীয় মাত্রা বছরে প্রতি ঘনমিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রাম। প্রতিবেদনে সিলেট, খুলনা ও বরিশালে এ বস্তুকণার উপস্থিতি মানমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জের বাতাসে পিএম-২.৫-এর উপস্থিতি রাজধানীর ফার্মগেটের চেয়ে বেশি। ফার্মগেটে এটির বার্ষিক গড় উপস্থিতি ৮৪ দশমিক ৫৩ মাইক্রোগ্রাম হলেও নারায়ণগঞ্জে তা ৯৪ দশমিক ০৫ মাইক্রোগ্রাম। এ ছাড়া গাজীপুরে এটির উপস্থিতি ফার্মগেটের প্রায় সমান। গাজীপুরে পিএম-২৫-এর উপস্থিতির পরিমাণ ৮৪ দশমিক ৩৯। এ ছাড়া আগ্রাবাদে এটির উপস্থিতি ৭৮ দশমিক ৭৮, বরিশালে ৬৫ দশমিক ৯৪, রাজশাহীতে ৬১ দশমিক ৬৭, খুলনায় ৫২ দশমিক ৬৭ ও সিলেটে ৪৫ দশমিক ৫৯ মাইক্রোগ্রাম। উল্লেখ্য, বাতাসে পিএম-২.৫-এর মান বা সহনীয় মাত্রা বছরে প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক এস এম মনজুরুল হান্নান খান প্রথম আলোকে বলেন, গড় হিসাবে নিলে মনে হতে পারে সারা বছর ধূলিদূষণ হয়। আসলে তা নয়। বছরের নভেম্বর থেকে মার্চ মূলত বায়ুদূষণ বেশি হয়। এ সময় বৃষ্টি হয় না, এ ছাড়া ইটভাটা, নির্মাণকাজ, গাড়ির ধোঁয়া ইত্যাদি কারণে এ সময় দূষণ বেশি হয়। অন্য সময় মানমাত্রার মধ্যে থাকে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত প্রতিবেদন ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭’ অনুযায়ী যেসব দেশের বাতাসে মারাত্মক ক্ষতিকর পিএম-২.৫ উপাদান বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।

বায়ুদূষণের কারণে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আসিফ মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সার্বিকভাবে শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা ব্যাহত হচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে শ্বাসনালির সমস্যা, ফুসফুসে সমস্যা, এজমার ঝুঁকি বাড়ে।