মেয়েটি 'মিথ্যা' ধর্ষণ মামলার ভুক্তভোগী

>একনজরে পরিসংখ্যান
ঢাকার পাঁচটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ছয়টি অপরাধে আসা ৭,৮৬৪টি মামলার চিত্র-
  • মামলাগুলো এসেছে ১৫ বছরে (জানুয়ারি ২০০২ থেকে অক্টোবর ২০১৬)।
  • ৭০ শতাংশ (৫,৫০২টি) মামলা হয়েছে ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত মৃত্যু ও হত্যা এবং গণধর্ষণের (মৃত্যু-হত্যাসহ) অভিযোগে। বাকিগুলো যৌতুকের জন্য হত্যা অথবা তার চেষ্টা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা এবং যৌন নিপীড়নের মামলা।
  • ধর্ষণসংক্রান্ত ৮৮ মামলায় সাজা হয়েছে। এগুলোর ৭০ শতাংশ হয়েছে আদালতে আসার পাঁচ বছরের মধ্যে। সবচেয়ে বেশি সময় পেরিয়ে (১০-১৩ বছর) সাজা হয়েছে ৭ শতাংশ মামলায়।
  • একটি মামলায় আসামিকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। চলমান ৩২টি মামলা শিশু আদালতে পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ এসব মামলার অভিযুক্তরা অপ্রাপ্তবয়স্ক। সূত্র: ট্রাইব্যুনালের বিচারিক নিবন্ধন খাতা

ক্ষুব্ধ, বিপর্যস্ত মেয়েটির সঙ্গে প্রথম কথা হয় গত অক্টোবরে। 

তার মাস তিনেক আগে ঢাকার ৫ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের রায়ে তাঁর করা ধর্ষণের মামলাটি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাব্যস্ত হয়েছে। আসামি বেকসুর খালাস পেয়েছেন।

ধর্ষণের অভিযোগ মেয়েটি এনেছিলেন প্রতিবেশী এক ‘মুরব্বি’র বিরুদ্ধে। ২০১২ সালে।

মুরব্বিটির মাথার ওপর সে সময় চাঞ্চল্যকর এক রাজনৈতিক খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজার খাঁড়া ঝুলছিল। হাইকোর্টে আপিল করে তিনি জামিনে বাইরে ছিলেন। অথচ ধর্ষণ মামলার অভিযোগপত্রে তাঁর খুনের মামলার উল্লেখ নেই।

২০১৪ সালে হাইকোর্ট খুনের মামলায় তাঁর যাবজ্জীবন সাজা বহাল রেখে জামিন বাতিল করেন। ইতিমধ্যে ধর্ষণের মামলায় জেলে গিয়ে খালাস পেয়ে তিনি বেরিয়ে আসেন।

মুরব্বির টাকার জোর আছে। আর মেয়েটির বাবা খেটে খাওয়া গরিব মানুষ।

প্রতিবেদকের সঙ্গে মেয়েটি কথা বলেছেন নিচু গলায়, থেমে থেমে। চোখ বারবার পানিতে ভরে গেছে।

আইনজীবীরা তাঁকে রায়ের তারিখ জানাননি। লোকের মুখে রায় শুনে ‘মাথায় আসমান ভাইঙ্গা পড়ছে। এত কষ্ট করছি আমি! আমার ওপর যে নির্যাতন গেছে, ‍উল্টা এখন আমি মিথ্যা হইয়া গেলাম না?’

পুরান ঢাকার মেয়েটি তখন দশম শ্রেণিতে পড়তেন। এক দুপুরে প্রতিবেশী ওই মুরব্বি ‘মামা’ নিজের মেয়ের সঙ্গে দেখা করাবেন বলে বাবার কাছ থেকে তাঁকে নিয়ে যান। তারপর পাশের এলাকায় আরেক বাড়িতে নিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করেন।

মেয়েটি প্রথমে লজ্জায় কাউকে জানাননি। দুই দিন পর মা-খালাদের বললেন-‘তখন মরতে গেছিলাম। বাড়ির সবাই আটকাইছে।’ তবে তাঁরা মামলা করতে চাননি-‘বলছে, থাক গা। মেয়েমানুষ, বিয়াশাদি দিব।’

কিন্তু এলাকায় কথা ছড়িয়ে গেল, বাবা মেয়েকে বিক্রি করেছেন। তখন মেয়েটি নিজেই থানায় গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করলেন, বাবাকেও ধরিয়ে দিলেন।

মেয়েটি বলেন, এজাহার লেখানোর সময় পুরুষ কর্মকর্তা ‘অনেক খারাপ খারাপ কথা বলছে। (ধর্ষণ) কী করছে না করছে, কীভাবে করছে, কেমনে করছে। এইগুলা জিজ্ঞাসা করছে।’

পুলিশ কর্মকর্তারা বলতেন, ‘মামলা করছে টাকার জন্য। টাকা দিলেই তুলে নেবে।’ তা ছাড়া, ‘গেছি ক্যান? মেয়েমানুষ এত বাইরে থাকবে ক্যান?’

প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) বলেছিলেন, মেয়েমানুষ মামলা করে কত দূর যেতে পারবে? দ্বিতীয় আইও ৫০ হাজার টাকায় আপস করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। হুমকি দিয়ে আপস করতে বলত মুরব্বির পরিবারের লোকজনও।
পরে পুলিশের ‘বড় অফিসার মোনালিসা ম্যাডাম’ আইওকে তিরস্কার করেন।

ডাক্তারি পরীক্ষার ফল মেয়েটির পক্ষে যায়। তবে পরীক্ষাটা ছিল ‘একপ্রকার নির্যাতনই। কাপড় গায়ের থেকে খুলে চেক করা হইছে।’ আয়াকে সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন পুরুষ ডাক্তার।

আদালতে ‘মানুষজন বাজে চোখে তাকায়।’ তবে বিপক্ষের উকিল ‘অপবাদ’ দিলে বিচারক তাঁকে থামিয়ে দেন।

শুনানি হয়েছে ভরা আদালতে-‘সবার সামনেই জিজ্ঞাসা করছে, কীভাবে নিয়ে গেছে, কী করছে।’ মেয়েটি শুধু মোটা দাগে বলেছেন, মুরব্বি জামাকাপড় খুলে ধর্ষণ করেন, তাঁর বন্ধু বাইরে পাহারা দেন আর দারোয়ান মুখ চেপে ধরেন।

মেয়েটির এক খালা বলেন, ‘প্রায়ই দৃশ্যটা চোখে ভাসে ওর। চিৎকার করে ঘরবাড়ি উঠায়া ফেলে।’ ঘটনার পর প্রায় দুই বছর মেয়েটি আরেক খালার বাসায় থেকেছেন। কারও সঙ্গে কথা বলতেন না।

খালাস পাওয়ার পর ‘মুরব্বি’ শাসিয়ে গেছেন, আপিল করলে ‘খবর আছে!’ ঘটনার পর পরিবারটি চারবার বাসা বদল করেছে।

এলাকায় মুরব্বি বলে বেড়িয়েছেন, পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে ছাড়া পেয়েছেন। তিনি কিন্তু নিজের পক্ষে কোনো আইনজীবী নিয়োগ দেননি।

মেয়েটির অভিযোগ, তিনি টাকা দিতে পারেননি দেখে সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মামলাটির যত্ন নেননি। তিনি বলেন, ‘পিপি মুহুরিদের দিয়ে অনেকবার টাকা চেয়েছে।’

অভিযোগটি অস্বীকার করে পিপি আলী আসগর বলেছেন, ‘রায়ে আমরা খুব হতাশ হয়েছি।’ তবে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

অভিযোগপত্রের তালিকায় পুলিশ কোনো নিরপেক্ষ সাক্ষী রাখেনি। মেয়েটির অভিযোগ, ‘হাতেনাতে প্রমাণ নাই, কিন্তু ওরাও টাকা খাইছে।’

আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে মা ঘটনার তারিখ গুলিয়ে ফেলেছিলেন। সাক্ষীদের কথায় কিছু অসংগতি ছিল। ডাক্তারের সাক্ষ্যে আর রিপোর্টে কিন্তু জোরপূর্বক সংগমের আলামত পাওয়ার কথা ছিল। শরীরে নখের আঁচড়ের কথা ছিল। তবে মেয়েটির সাক্ষ্যে এ কথা ছিল না। তাই বিচারকের কাছে ডাক্তারের সাক্ষ্য ‘সত্য মর্মে গ্রহণযোগ্য’ হয়নি।

উচ্চ আদালতে আপিল করার খুব ইচ্ছা ছিল মেয়েটির। টাকা জোগাড় করে আদালত থেকে কাগজপত্র তুলেছিলেন, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। পরিবারও আর মামলার ঝামেলায় যেতে চায় না।

ইতিমধ্যে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে কলেজে ঢুকেছেন মেয়েটি। বিয়েও হয়েছে।

ধর্ষণের শিকার মেয়েদের তিনি বলতে চান, ‘যদি সব দিক দিয়ে সাপোর্ট পাওয়া যায়, তাহলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে নিজের জীবন নিজে সুন্দর করে গড়া উচিত।’

আর সরকারের কাছে তাঁর ফরিয়াদ, ‘যে অন্যায় করছে, তাকে শাস্তি দেও। আমারে লুকায়া হাঁটতে হইতাছে। আর ওরা প্রকাশ্যে সুন্দরভাবে ঘুরতাছে!’

মেয়েটি বলেন, ‘ও আমার কোনো একটা ক্ষতি আইজ হইলেও করব, ১০ বছর পর হইলেও করব।’