সুন্দরবনে ডলফিন শুমারি

সুন্দরবনের ঢাংমারী খালে ডলফিন।  ছবি: ডব্লিউসিএস
সুন্দরবনের ঢাংমারী খালে ডলফিন। ছবি: ডব্লিউসিএস

ঢাংমারী খালে একটা গাছে বোট বেঁধে আমরা জনাদশেক ক্যামেরা লাগিয়ে খর চোখে তাকিয়ে আছি পানির দিকে। ঢাংমারী খাল এখানটায় সুন্দরবনের পশুর নদের সঙ্গে মিশেছে। পূর্ণিমার জোয়ার শেষ হয়ে ভাটিতে পানি নামছে যেন পৃথিবী কাত হয়ে। জোয়ার-ভাটার পানির তীব্র তোড়ে তাদের খুব স্ফূর্তি। এই বুঝি দেখা যায়, আরে ওই তো দূরে একটি ভেসেছে। দূরে চলে যায় ক্যামেরার ফোকাস। এ সময় সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের ঠিক নাকের ডগায় ভেসে ওঠে একটি।

দ্বিতীয়বারের মতো সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ডলফিন গণনা চলছে। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির অর্থায়নে এবং ইউএনডিপির সহায়তায় বন বিভাগের পরিচালনায় এতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান।

পৃথিবীতে ডলফিন আছে মোট ৪০ রকমের (প্রজাতি-উপপ্রজাতি মিলিয়ে)। এর মধ্যে মিঠাপানির নদীতে বাস করে মাত্র পাঁচটি প্রজাতি। গঙ্গা, সিন্ধু, আমাজন, ইয়াংজি ও মেকং নদীতে এরা বাস করে। ইয়াংজি নদীর ডলফিনের সুস্পষ্ট খোঁজ অনেক দিন নেই। বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, সিন্ধু নদীর শুশুক গাঙ্গেয় শুশুকেরই উপপ্রজাতি। আর মেকং নদীর ইরাবতী ডলফিনকে ঠিক নদীর ডলফিন বলা যায় না। এরা আসলে উপকূলীয় ডলফিন, নদীতে ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশের নদীতে এ ডলফিন প্রচুর পাওয়া যায়।

পৃথিবীর সব নদীতেই বর্ষার দিনে পানি ঘোলা থাকে। নদীর পানিতে ডলফিনরা প্রায় জন্মান্ধ, এদের চলাফেরা, শিকার ধরার জন্য বাদুড়ের মতো ইকো লোকেশনের দরকার হয়। আমাজন নদীর ডলফিনরা অবশ্য কিছুটা দেখতে পায়।

বাংলাদেশের সুন্দরবনে চারটি প্রজাতির ডলফিনজাতীয় প্রাণী দেখা যায়। এদের মধ্যে ইন্দোপ্যাসিফিক হামব্যাক ডলফিন শীতের মৌসুমে সুন্দরবনের নদী ও খাঁড়িতে এসে পড়ে। ইরাবতী ডলফিন সারা বছরই জঙ্গলের নদী, খাঁড়িতে বসবাস করে। আর শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিন মূলত মিঠাপানির প্রাণী, কিন্তু বেশ লবণ সহ্য করতে পারে বলে সুন্দরবনের পূর্বাংশে এদের বেশি দেখা যায়। আর একটি ক্ষুদ্র ডলফিন—রিভার পরপয়েজ, শুধু বড় নদীগুলোতে থাকে; এরা সংখ্যায়ও খুব কম।

৫০ বছর আগে দেশের প্রায় সব বড় নদী ও তাদের শাখাসমূহে গাঙ্গেয় শুশুক দেখা যেত। বর্ষাকালে এরা ছোট খালে, এমনকি গভীর বিল-ঝিলে ঢুকে পড়ত। ডব্লিউসিএস বাংলাদেশের ডলফিন গবেষক রুবাইয়াত মনসুর জানালেন, যেখানে দুটি নদীর সঙ্গমে পানিপ্রবাহ তীব্র গতিতে পাক দিয়ে ঘোরাফেরা করে, গাঙ্গেয় শুশুক সেসব এলাকায় স্থায়ী হয়। পক্ষান্তরে ইরাবতী ডলফিন এক দিনেই অনেকখানি এলাকা চষে বেড়ায়। পরের দিন একই এলাকায় ঘুরে আসে।

সুন্দরবনে প্রথম শুশুক গণনা করেছিল ডব্লিউসিএস-বাংলাদেশ। তাদের গণনায় সুন্দরবনে গাঙ্গেয় শুশুক পাওয়া গিয়েছিল ২০০টি, ইরাবতী শুশুক পাওয়া গিয়েছিল ৪২৫টি।

প্রকল্প অধিকর্তা মোহাম্মদ মদিনুল আহসান জানালেন, ‘আমরা শুশুকের সংখ্যা আরও নির্দিষ্ট করতে, নতুন হটস্পষ্ট খুঁজে বের করতে, শুশুকের বিপদগুলো চিহ্নিত করতে, সেই সঙ্গে শুশুক অভয়ারণ্যের অঞ্চল বাড়াতে চাইছি।’ ইউএনডিপির সহকারী কান্ট্রি ডিরেক্টর মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানালেন, ‘জলের তলায় যারা বাস করে, তাদের সম্পর্কে আমরা কম জানি। এ প্রকল্প কিছুটা হলেও তাদের জীবন প্রকাশ্য করবে। সরকারের সঙ্গে দেনদরবার চলছে, আমরা ডলফিন সংরক্ষণ এলাকা বর্তমানের ৫০ কিলোমিটার থেকে ৫০০ বর্গকিলোমিটারে উন্নীত করতে চাই। প্রকল্প এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে—এমন পাঁচ হাজার জেলে পরিবারকে সহায়তার কার্যক্রম থাকছে।’ প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ রেজাউল কবীর চৌধুরী জানালেন, প্রকল্প চলছে সম্পূর্ণ সরকারি ব্যবস্থাপনায়, বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞের সহায়তায়। ফলে প্রকল্পে আহরিত জ্ঞান ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলোর জন্য সহায়ক হবে।