পাখির ডানায় বিশ্ব দেখা

সংগ্রাহক সামসুল আলম। নিজ বাসায় পাখি নিয়ে ছাপা টাকা আর ডাকটিকিটের অ্যালবাম নিয়ে।
সংগ্রাহক সামসুল আলম। নিজ বাসায় পাখি নিয়ে ছাপা টাকা আর ডাকটিকিটের অ্যালবাম নিয়ে।

দেশ-বিদেশের পাখিতে ঘরভর্তি। একটি হয়তো সাদা বরফের মধ্যে বসে আছে, আরেকটি মরুভূমির মধ্যে। চারপাশেই পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। তবে এই শব্দ শুধু অনুভব করতে হয়, কানে শোনা যায় না। কারণ, পাখিগুলো যে ডাকটিকিট বা ব্যাংক নোটের গায়ে ছাপানো।

বাংলাদেশে প্রথম ডাকটিকিট বের করা হয় ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই। আর পাখি নিয়ে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালের ১৭ আগস্ট। বাংলাদেশে পাখি নিয়ে এ পর্যন্ত মোট ৬০টি ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে, ঘরটিতে সব ডাকটিকিটই যত্ন করে রাখা আছে। এ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় ২৭০টি দেশ ও অঞ্চল থেকে (কোনো কোনো দেশের কয়েকবার নাম পরিবর্তন হয়েছে) এ পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি পাখির ডাকটিকিট বের হয়েছে। এই ঘরটি আসলে ১৭ হাজার পাখির ডাকটিকিটের সংগ্রহশালা।

সংগ্রাহক বেসরকারি চাকরিজীবী সামসুল আলম। ধানমন্ডিতে নিজ বাসায় তিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর পাখির ডাকটিকিট নিয়ে শখের এ সংগ্রহশালা। জানালেন, তাঁর মা নুরুন নাহার বেগম ১৯৯৯ সালে মারা গেছেন। তিনি ছেলের শখকে প্রাধান্য দিতেন। ২০১১ সালে একুশে পদকপ্রাপ্ত ৯৫ বছর বয়সী বাবা হাজি আবুল হাশেমও ছেলেকে বরাবরই উৎসাহ দিচ্ছেন। ১৯৭০ সালে বাবা ছিলেন গণপরিষদের সদস্য। মূলত বাবার কাছে আসা বিভিন্ন চিঠিপত্রে ডাকটিকিট দেখেই তা সংগ্রহের ইচ্ছা জাগে। আস্তে আস্তে শখ শুধু পাখিতে গিয়ে আটকে যায় বলে জানালেন সামসুল আলম।

 সামসুল আলম ফিরে গেলেন সত্তরের দশকে। তিনি জানালেন, তাঁরা ২ ভাই, ১০ বোন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ৩৬ কাঠার বাড়িতে বাগান ছিল। আসত অনেক পাখি। টিয়া বসত সূর্যমুখী ফুলে। গরু, হাঁস, মুরগি, বিড়াল—সবই ছিল বাড়িতে। আস্তে আস্তে শহুরে জীবনে পাখিসহ অন্যান্য জীবজন্তুর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ কমতে থাকে। এখন পাখিগুলোকে অ্যালবামে যত্ন করে রেখেছেন। তবে খাঁচায় পাখি পোষার ঘোর বিরোধী তিনি।

সামসুল আলম আলমারির ভেতর থেকে অ্যালবামগুলোর কয়েকটি বের করলেন। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সুন্দর সুন্দর পাখির ছবির ডাকটিকিট। অ্যালবামের অনেকগুলো জায়গা ফাঁকা রেখে দিয়েছেন। কেননা কিছু কিছু সংগ্রহ তো এখনো বাকি আছে। প্রতিটি অ্যালবামেই এভাবে ফাঁকা জায়গা আছে। কী উপলক্ষে ডাকটিকিট ছাপানো হয়েছে, কত তারিখে প্রকাশ করা হয়েছে, ইন্টারনেট থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্যও লিখে রেখেছেন ছবিগুলোর নিচে।

সামসুল আলম হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি কিন্তু পাখি বিশেষজ্ঞ না। পড়াশোনা করতেও ভালো লাগে না। কিন্তু শখের সংগ্রহের জন্য প্রতিনিয়তই পড়াশোনা করছি। পৃথিবীতে প্রায় ৯ হাজার প্রজাতির পাখি আছে। বাংলাদেশে আছে ৪৫০ প্রজাতির। ডাকটিকিটে থাকা পাখি দেখে কোন দেশের আবহাওয়া কেমন, দেশটি বিশ্বের মানচিত্রের কোন জায়গায় অবস্থিত, দেশটির সংস্কৃতি—এসব তথ্য মোটামুটি নখদর্পণে। কানাডায় দোয়েলের লেজ আমাদের দেশের দোয়েলের চেয়ে একটু বড়। এটি হয়েছে আবহাওয়ার কারণে। টিয়া পাখি একসময় খুব বন্ধুবৎসল ছিল, এখন মানুষ দেখেই ভয় পায়...।’

পৃথিবীতে পাখি নিয়ে প্রথম ১৮৭৫ সালে ডাকটিকিট বের করে জাপান। সামসুল আলম এ ডাকটিকিটটি সংগ্রহের চেষ্টা করছেন বলে জানালেন। তিনি বলেন, ‘এটি সংগ্রহ করতে প্রচুর খরচ হবে। আমিও বলেছি, যতই খরচ হোক, এটি আমার লাগবে। জানেন তো, একসময় ডাকটিকিট সংগ্রহকে রাজার শখ হিসেবে গণ্য করা হতো।’

২০১৩ সালের পর থেকে শুধু এশিয়া এবং এশিয়ার বাইরে কয়েকটি দেশের ডাকটিকিট সংগ্রহ করছেন সামসুল আলম।

ব্যাংক নোটেও পাখি

এ পর্যন্ত ১৩০টি দেশ প্রায় ১ হাজার ৫০০ ব্যাংক নোট ছাপিয়েছে পাখির ছবি দিয়ে। সামসুল আলম জানালেন, তাঁর সংগ্রহে ১০০টি দেশের প্রায় ৬০০ ব্যাংক নোট আছে। অ্যালবাম থেকে ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশের ১ টাকা নোটে ৬টি মুরগির বাচ্চার ছবি দেখালেন সামসুল আলম। যদিও মুরগিকে পাখি ধরা হয় না, তারপরও এটি সংগ্রহে রেখেছেন। ১৯৮৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর দোয়েল পাখির ছবি দিয়ে ছাপানো হয় ২ টাকার নোট। ১৯৭২ সালের ১০ টাকার নোটের মাঝখানের নকশার মধ্যে পাতার ওপরে পাখির চিত্র আছে। ২০০০ সালে প্রথম পলিমার ১০ টাকার নোটেও আছে দোয়েলের ছবি। ১৯৭৬ সালের ৫০ টাকার নোটে আছে দুটো ময়ূর। সামসুল আলম এভাবে এক অ্যালবাম থেকে আরেক অ্যালবামে করে এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যাচ্ছেন আর নানা রকম পাখির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন।

সামসুল আলমের স্ত্রী ফারজানা ইয়াসমিন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। একমাত্র মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া নাহলা আলম শিখছে লোকসংগীত। সামসুল আলমের মতে, অবসর সময়ে একেকটি অ্যালবাম নিয়ে বসলে কোন দিক দিয়ে সময় চলে যায়, তা তিনি টেরই পান না। তাই অবসরে একাকিত্ব দূর করবে এ শখ। এ শখের জন্য কত টাকা খরচ হলো, তা মুখ্য নয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ শখকে ছাড়া যাবে না। একটা সময় মেয়ে বাবার শখের সংগ্রহশালার হাল ধরবেন—এটাই আপাতত প্রত্যাশা সামসুল আলমের।