ঢাকা-১৬ আসনে মাঠে আওয়ামী লীগের দুই মোল্লাহ্, বিএনপির প্রার্থীরা নীরব

ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌, এখলাস উদ্দিন মোল্লাহ্‌, এস এম মান্নান ও রফিকুল ইসলাম মিয়া
ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌, এখলাস উদ্দিন মোল্লাহ্‌, এস এম মান্নান ও রফিকুল ইসলাম মিয়া
>
  • ঢাকার উত্তরের সীমান্তবর্তী মিরপুরের পল্লবী ও রূপনগর থানা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৬ আসন।
  • ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড এই আসনের অন্তর্ভুক্ত।
  • ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৬৩ হাজার।
  • মিরপুরের আসনটিতে ‘মোল্লাহ্’ পরিবারের একটা দৃশ্যমান প্রভাব আছে।

ঢাকা-১৬ আসনে ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনবার আওয়ামী লীগ, দুবার বিএনপি জিতেছিল। আসনটিতে দল দুটির পাল্টাপাল্টি জেতার ধারা উল্টে যায় বহুল আলোচিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে, যাতে বিএনপি অংশ নেয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে ভোটের হিসাব-নিকাশ জটিল হবে। যদিও এখনো বিএনপি সেভাবে মাঠে নেই। দলটির নামকরা সম্ভাব্য কোনো প্রার্থীরও দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। কার্যত নয় বছর ধরে এলাকায় সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌র একচ্ছত্র আধিপত্য। নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়নে, প্রচারে-পোস্টারে দৃশ্যত আওয়ামী লীগের অবস্থান ভালো। তবু স্থানীয় লোকজনের ধারণা, আড়ালে বিএনপিও শক্তিশালী। প্রার্থী যিনিই হোন, আওয়ামী লীগের জন্য জেতা এত সহজ হবে না।

রাজধানী ঢাকার উত্তরের সীমান্তবর্তী মিরপুরের পল্লবী ও রূপনগর থানা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৬ আসন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২,৩, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড এই আসনের অন্তর্ভুক্ত। ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৬৩ হাজার। একসময় বৃহত্তর মিরপুরের এই আসনটি ছিল ঢাকা-১১–তে। তা ভেঙে তিনটি আসন করা হয়। তার মধ্যে ঢাকা-১৪ আসনের বর্তমান সাংসদ আসলামুল হক, ১৫ আসনে কামাল আহমেদ মজুমদার আর ১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্। তিনজনই আওয়ামী লীগের।

বিগত পাঁচটি নির্বাচনের (৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাড়া) ফলাফলে দেখা গেছে, মিরপুরের এই আসনটিতে ‘মোল্লাহ্’ পরিবারের একটা দৃশ্যমান প্রভাব আছে। কারণ, এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলে পাঁচটি জয়ের তিনটিতেই আছেন মোল্লাহ্‌রা। এর মধ্যে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এ আসনে (অবিভক্ত) বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন প্রয়াত হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্। এরপর আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হন তাঁরই মেজ ছেলে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্। মাঝে ১৯৯৬ সালে কামাল আহমেদ মজুমদার আওয়ামী লীগ থেকে আর ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির এস এ খালেক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালের নভেম্বরে সাংসদ হারুন মোল্লাহ্ মারা গেলে উপনির্বাচনে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এস এ খালেকের বড় ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ মহসীন। তিনি পরে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে গেলে এ আসনে প্রার্থী হন তাঁর বাবা এস এ খালেক। এখনো তিনি বিএনপিতে আছেন।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্ভাব্য একাধিক প্রার্থী ও এলাকাবাসী বলছেন, মিরপুরের শেষ প্রান্তের এই আসনটিতে বড় সমস্যা ‘মাদক’। এরপর আছে পয়োনালার অভাব, খানাখন্দ ও রাস্তাঘাটের দুর্ভোগ। আছে তৈরি পোশাকের কারখানা ঘিরে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি। বছরে কয়েক দফায় এলাকার নানা বস্তিতে আগুন লাগে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বর্ধিত পল্লবীর একজন স্থায়ী বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার মাদক, চাঁদাবাজি, বস্তির আগুন—সবকিছুর পেছনে একজন জনপ্রতিনিধির মদদ আছে।

ইলিয়াস মোল্লাহ্ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বস্তিতে আগুন ধরলেই তো ইলিয়াস মোল্লাহ্‌র নাম। সাংবাদিকদের কী দোষ, কিছু লোক বস্তির সামনে তাদের ২৫ থেকে ৩০ জন লোক বসিয়ে রাখে। সাংবাদিক এলেই তারা বলে সব ইলিয়াস মোল্লাহ্ করেছে।’

এলাকায় ঘুরে ও স্থানীয় লোকজনের অভিযোগে জানা গেছে, মিরপুর ১০ নম্বর, ঝুট পট্টি, প্যারিস রোড, ১১ নম্বর বাজার রোড, কালশী রোড, বিহারিদের বস্তি, ১২ নম্বর ‘ত’ ও ‘ধ’ ব্লক, শহীদবাগ, কামাল মজুমদার রোড, সিরামিক রোড, দুয়ারিপাড়া, ঝিলপাড় বস্তি—এসব এলাকায় দেদার মাদক বিক্রি হয়। এতে শত শত তরুণ নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু জনপ্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদক নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

এরপর আছে পয়োনালা ও রাস্তাঘাটের দুর্ভোগ। পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টি হলেই অনেক এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। এর মধ্যে পল্লবীর বি ব্লক, কালশী, বাউনিয়া বাঁধ এলাকা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া রূপনগর, ৬ নম্বর, বর্ধিত পল্লবী, ইস্টার্ন হাউজিং আবাসিক এলাকা, আলবদী গ্রামে রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ। নির্বাচনী আসনের চারটি ওয়ার্ডের তিনটিতেই সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কমিউনিটি সেন্টার নেই। কেবল ২ নম্বর ওয়ার্ডে কমিউনিটি সেন্টার আছে। ফলে এলাকাবাসীকে অনেক টাকা খরচায় ব্যক্তিগত কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে।

সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ্ দাবি করেন, তিনি এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার রাস্তা সংস্কার করেছেন। এলাকাকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইমুক্ত করেছেন। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনেকে প্রথম আলোকে বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মিরপুরের যেসব রাস্তা সংস্কার ও প্রশস্ত করা হয়েছে বা হচ্ছে, এর সবই প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের উদ্যোগে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে এই আসনে প্রার্থিতা নিয়ে আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব আছে। দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বেশির ভাগই বর্তমান সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ্‌র বিপক্ষে। আবার নির্বাচন ঘিরে মোল্লাহ্ পরিবার ও গোষ্ঠীতেও বিভক্তি আছে। সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ্‌র বড় ভাই এখলাস উদ্দিন মোল্লাহ্ও মনোনয়ন চাইবেন, যিনি ২০০৮ সালে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ইতিমধ্যে এখলাস মোল্লাহ্ এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টার লাগিয়েছেন।

ভাইয়ের পোস্টারের বিষয়ে ইলিয়াস মোল্লাহ্ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি (এখলাস মোল্লাহ্) পোস্টারে লিখেছেন সর্বস্তরের জনগণ, জনগণটা কে? আসলে নির্বাচন এলেই ওনার শরীর চুলকায়। এটা তো হয় না।’

এই মন্তব্যের জবাবে এখলাস মোল্লাহ্ বলেন, ‘সে তো একটা বেয়াদব। ময়মুরব্বি মানে না, নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করে না। সেদিন আমার বাবার সমতুল্য চাচাকে মসজিদের ভেতরে অপমান করেছে। মোল্লাহ্ পরিবারের সুনাম নষ্ট করার তার কোনো অধিকার নেই, আমারও নেই।’

এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে দুই মোল্লাহ্‌র শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এস এম মান্নান ওরফে কচি। তিনি তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের (উত্তর) সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এস এম মান্নান ২০১৪ সালের নির্বাচনে ইলিয়াস মোল্লাহ্‌র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ২৫ হাজার ১৩৩ ভোট পান। ইয়িলাস মোল্লাহ্ পেয়েছিলেন ৩৫ হাজার ৮৫৫ ভোট।

এস এম মান্নান ২০১৪ সালের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) যদি মিরপুরে ইলিয়াস মোল্লাহ্‌র সমাবেশে না যেতেন, তাহলে ফলাফল ভিন্ন হতো। আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে আমি মনোনয়ন চাইব। না দিলে দল যাঁকে নৌকা প্রতীক দেয়, তাঁর জন্য কাজ করব।’

এর বাইরে মহিলা আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগরীর সভাপতি শাহিদা তারেখ, মুক্তিযোদ্ধা আমীর হোসেন মোল্লাহ্ ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের (উত্তর) সাংগঠনিক সম্পাদক ফকির মহিউদ্দিনও মনোনয়নপ্রত্যাশী। ফকির মহিউদ্দিন হারুন মোল্লাহ্‌র ছোট ভাই আবদুর রশীদ মোল্লাহ্‌র মেয়ের জামাই। শাহিদা তারেখ সাবেক কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ।

অবশ্য নিজের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন কোনো অপরাধ করিনি যে মনোনয়ন পাব না। এলাকার মানুষের সব দাবি-প্রত্যাশা পূরণ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে যা চেয়েছি, তা-ই পেয়েছি।’

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, এই আসনে প্রার্থিতা নিয়ে বিএনপিতে তেমন বিরোধ নেই। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এখানে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া। তিনি ইলিয়াস মোল্লাহ্‌র কাছে বড় ব্যবধানে পরাজিত হন। তিনি এই এলাকার বাসিন্দা নন। বিহারিদের নাগরিকত্ব প্রশ্নে একটি মামলায় রফিকুল ইসলাম উচ্চ আদালতে তাদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন। মিরপুরের এই আসনটিতে বিহারিদের বড় একটি অংশের বসবাস আছে। সে বিবেচনায় বিএনপি তখন তাঁকে প্রার্থী করেছিল।

অসুস্থতার কারণে রফিকুল ইসলাম মিয়া অনেক দিন ধরে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় বলে জানা গেছে। তবে রফিকুল ইসলাম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সুস্থ। দল নির্বাচনে গেলে নির্বাচন করতে চাই। বাকি দলের সিদ্ধান্ত।’

এর বাইরে আসনটিতে বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ১৭ বছর কাউন্সিলর ছিলেন। ডেপুটি মেয়রও ছিলেন। এলাকায় তাঁর সাংগঠনিক যোগাযোগ ভালো। তবে মামলা-মোকদ্দমার কারণে তিনি প্রকাশ্যে নেই। আহসান উল্লাহ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল যদি নির্বাচনে যায়, আমাকে মনোনয়ন দেয়, আমি এ জন্য প্রস্তুত। এই এলাকার অলিগলি, ঘরবাড়ি সবই আমার চেনাজানা।’

এ ছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক ও ঢাকা মহানগর বিএনপির (উত্তর) সহসভাপতি এ কে এম মোয়াজ্জেম হোসেনও মনোনয়ন চাইবেন। আমিনুল ২০১৪ সালে বিএনপিতে যোগ দিয়ে দ্রুত দলে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর খেলাধুলা, বেড়ে ওঠা এই এলাকায়। আর মোয়াজ্জেম দলের পুরোনো কর্মী। তিনি এলাকায় সরকারি জমি বরাদ্দ নিয়ে জিয়াউর রহমানে নামে দুটি হাইস্কুল ও কলেজ করেছেন। তিনি এলাকায় বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আছেন। যদিও সম্প্রতি তাঁর করা দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম পাল্টে দিয়েছেন সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহ্।