ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বন্যাপ্রবাহ এলাকা গায়েব

ড্যাপে এই পর্যন্ত যত সংশোধনী হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে আত্মঘাতী হলো বন্যাপ্রবাহ এলাকা ভরাটের অনুমতি দেওয়া। কারণ, এর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে। কোনো কোনো সংশোধনীতে অনেকটা মৌজা ধরে ভরাটের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

বর্ষায় পানিনিষ্কাশন, জীববৈচিত্র্য ও তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষার জন্য বন্যাপ্রবাহ এলাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মন্ত্রিসভা কমিটি ১৪টি সংশোধনীর মাধ্যমে এমন এলাকা ভরাটের অনুমোদন দেয়।

সংশোধনীগুলোর ১২ টির মাধ্যমে বন্যাপ্রবাহ এলাকায় আবাসন প্রকল্প, একটিতে শিল্পকারখানা ও অন্যটির মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ভবন নির্মাণের অনুমতি পেয়েছেন প্রভাবশালী আবাসন ব্যবসায়ীরা।

২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক গেজেট অনুযায়ী, মন্ত্রিসভা কমিটির পঞ্চম সভার এক সিদ্ধান্তে বড় বরদেশি মৌজার ৯৮টি দাগের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের এই জমিগুলোতে এখন আবাসন প্রকল্প হচ্ছে।

২০১৫ সালের ২৮ জুলাই প্রকাশিত আরেক গেজেট অনুযায়ী, কেরানীগঞ্জের নাইয়াটোলা, হাজারীবাগ, দোলেশ্বর, আইন্তা, বেয়ারা, আড়াকুল, বীরবাঘৈর, মোটবাড়ী, পূর্ব বাঘৈর, পানগাঁও, ব্রাহ্মণসাঁও, কাটুরাইল, বাক্তা ও কোন্ডা মৌজার ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়। এর বড় অংশ ছিল বন্যাপ্রবাহ এলাকা।

ড্যাপে বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত জমিতে অনুমোদন পাওয়া আবাসন প্রকল্পগুলো হচ্ছে-প্রবাসী পল্লি, জলসিঁড়ি, প্রিয় প্রাঙ্গণ, রুপালি সৈকত, বনশ্রী নিউ টাউন, বসুন্ধরা, বসুন্ধরা সিটি ভিউ, বসুন্ধরা রিভারভিউ, বসুন্ধরা গ্রিন টাউন, প্রত্যাশা, সাউথ টাউন ও নর্থ টাউন আবাসিক প্রকল্প।

জানতে চাইলে মন্ত্রিসভা কমিটির অন্যতম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এই অনুমোদনের কারণে যাতে জলাবদ্ধতা না হয় সে জন্য ঢাকাকে দুই অংশে ভাগ করে আইডব্লিউএম (ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং) এবং সিইজিআইএস (সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস)-এর মাধ্যমে সমীক্ষা করা হয়েছে। সমীক্ষা দুটিকে ভিত্তি ধরে কারিগরি কমিটি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশের আলোকে মন্ত্রিসভা কমিটিতে আলোচনা করে সংশোধনী আনা হয়েছে। সংশোধনীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকায় যাতে বৃষ্টির পানি বের হয়ে যেতে পারে সেই ব্যবস্থা (ওয়াটার মডেলিং) রাখতে বলা হয়েছে।

মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে টঙ্গীর প্রত্যাশা আবাসিক প্রকল্পসহ সরকারি বেসরকারি ১৬ প্রকল্প ড্যাপের স্বার্থে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল ড্যাপ তৈরির সময়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি। ড্যাপেও এ সুপারিশ আছে।

প্রত্যাশা আবাসিক প্রকল্পটি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। এর জমির পরিমাণ প্রায় ৫০ একর। সরেজমিনে দেখা গেছে, তুরাগ নদের কূল ঘেঁষে প্রকল্পটি গড়ে উঠছে। ইতিমধ্যেই প্রকল্প এলাকার সব জমি ভরাট হয়ে গেছে।

সরেজমিনে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এই এলাকাটি নিম্নাঞ্চল ছিল। বর্ষায় পানিতে ডুবে থাকত, আর অন্য সময় ধানের চাষ হতো।

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, বর্ষায় জলাধারে পানি ধারণ ও মাটিতে শুষে নেয়ার পর যে পানি থাকে সেটি বন্যাপ্রবাহ এলাকায় এসে দাঁড়ায়। পরে সেখান থেকে নদীতে যায়। বর্ষা ছাড়া অন্য সময় এই জমিতে চাষ করা যায়। বন্যাপ্রবাহ এলাকা ধ্বংস হলে পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে ও জলাবদ্ধতা তৈরি হবে। জীববৈচিত্র্য নষ্টের পাশাপাশি শহরের উষ্ণতা বাড়বে।

প্রকল্পগুলোতে ওয়াটার মডেলিংয়ের মাধ্যমে পানি সরানোর ব্যবস্থা সম্পর্কে আকতার মাহমুদ বলেন, পুরো শহর বা অঞ্চল না করে শুধু নির্দিষ্ট এলাকা ধরে করা ওয়াটার মডেলিং কাজে আসবে না।