ড্যাপে ৮ বছরে ১৫৮ বার সংশোধনী এনেছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিসভা কমিটি

ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) ৮ বছরে ১৫৮ বার সংশোধনী এনেছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিসভা কমিটি। এর মাধ্যমে ড্যাপে নির্ধারিত জলাধার ও বন্যাপ্রবাহ এলাকার বড় একটি অংশ ভরাটের অনুমতি পেয়েছে প্রভাবশালীরা।

পরিকল্পিত উপায়ে ঢাকা গড়তে ২০১০ সালে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ)। পর্যালোচনা করে এটি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সাত সদস্যের মন্ত্রিসভা কমিটিকে। কিন্তু আট বছরেও তারা ড্যাপ চূড়ান্ত করেনি। কিন্তু ঢাকার জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ জলাধার ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা একের পর এক ভরাটের অনুমতি দিচ্ছে এই কমিটি।

জলাধার ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা ভরাটের অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি, হামিদ রিয়েল এস্টেট, জলসিঁড়ি আবাসন প্রকল্প, বসুন্ধরা গ্রুপ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড, প্রবাসী পল্লী গ্রুপ অন্যতম।

এ পর্যন্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদিত ১৩৫টি গেজেট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯টি সংশোধনী নিয়ে একটি এবং ৬টি সংশোধনী নিয়ে আরেকটি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। বাকি ১৩৩টি সংশোধনীর প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা গেজেট প্রকাশ করা হয়। সংশোধনীগুলোর সব কটিতেই জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে।
৪ এপ্রিল সর্বশেষ সভা করেছে মন্ত্রিসভা কমিটি। সভায় উপস্থিত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, এ সভায়ও জমির শ্রেণি পরিবর্তন-সংক্রান্ত ২০টি আবেদন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর কয়েকটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

এই সংশোধনীগুলো এখনো গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়নি। আজও এই কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
একের পর এক জমির শ্রেণি পরিবর্তন করলেও অধিকাংশ গেজেটে দেখা গেছে, আগে জমিটি কোন শ্রেণিভুক্ত ছিল, তা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে সাধারণ কারও পক্ষে তা আর খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় ভৌগোলিক তথ্যব্যবস্থা (জিআইএস) প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে ১৩৫টি গেজেটে উল্লেখ করা জমির দাগ নম্বর পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তাতে ১৪৮টি আবেদনে পরিবর্তনের আগে ড্যাপে নির্ধারিত ভূমির শ্রেণি কী ছিল, সে তথ্য বেরিয়ে আসে। ১০টি আবেদনে কোন কোন জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে, সে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ৩৪টি সংশোধনীর মাধ্যমে জলাশয় ভরাট ও ১৪টি সংশোধনীর মাধ্যমে বন্যাপ্রবাহ এলাকা ভরাটের অনুমতি দিয়েছে মন্ত্রিসভা কমিটি। ২০টি সংশোধনীর মাধ্যমে ড্যাপে চিহ্নিত কৃষি ও গ্রামীণ বসতি এলাকা বাতিল করা হয়েছে। চারটি সংশোধনীর মাধ্যমে অসংগতিপূর্ণ এলাকাকে (নন-কনফার্মিং জোন) সংশোধন না করে আবাসিক ও শিল্প একসঙ্গে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না (ওভার লে জোন), এমন ক্ষেত্রেও ১৩টি সংশোধনীর মাধ্যমে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমতি দিয়েছে এই কমিটি।

নগরবিদেরা বলছেন, এভাবে একের পর এক সংশোধনী মন্ত্রিসভা কমিটির মূল কাজ ও চেতনাবিরোধী। কমিটি গঠনের সময় সরকার গেজেটে বলেছে, এই কমিটি বিদ্যমান ড্যাপ বিশদভাবে পর্যালোচনা করে তা চূড়ান্ত করবে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তাতে এই কমিটি কার্যত ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনসংক্রান্ত কমিটিতে রূপ নিয়েছে। এ কাজ করার ক্ষমতা বিদ্যমান নগর উন্নয়ন ও জলাধার সংরক্ষণ আইনে রাজউকেরই আছে।
পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে শ্রেণি পরিবর্তনে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ভূমি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে, শহর হিসেবে দেশের রাজধানীর স্বার্থ রক্ষা করছে না মন্ত্রিসভা কমিটি।

এ বিষয়ে কথা বলতে মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। পরে মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে মন্ত্রীর কাছে পাঁচটি প্রশ্ন পাঠানো হয়। মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রী তাঁকে বলেছেন, কমিটিতে তিনি শুধু সমন্বয়কের কাজ করেন। ড্যাপের বিষয়ে জানতে হলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে হবে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে সম্প্রতি তাঁর দপ্তরে কথা হয়। তিনি দাবি করেন, ড্যাপ চূড়ান্ত না করে একটি একটি করে সংশোধনী আনা মন্ত্রিসভা কমিটি গঠনের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
৩৪টি সংশোধনীতে জলাধার ভরাট ও ১৪টিতে বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল ভরাটের অনুমতি দেওয়া সম্পর্কে গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, কারিগরি কমিটি সরেজমিনে দেখেছে, এগুলো আগে থেকেই ভরাট ছিল। তাই অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
আট বছরেও ড্যাপ চূড়ান্ত করতে না পারার নির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে কি না, জানতে চাইলে গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। চূড়ান্ত হয়নি, হবে।
তবে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন, ড্যাপ চূড়ান্ত না করে ব্যক্তিগত আবেদন একটি একটি করে নিষ্পত্তি করার এই প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার গন্ধ থেকে যাবে।

সংশোধনীর মাধ্যমে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বার্থ দেখার অভিযোগের জবাবে মন্ত্রিসভা কমিটির আরেক সদস্য এবং পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ দেখে সংশোধনী আনা হয়নি। আবেদন যৌক্তিক কি না, তা দেখে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভা কমিটি জমির শ্রেণি পরিবর্তন কমিটিতে রূপ নিয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ড্যাপের কারণে অনেকেই অসুবিধায় পড়েছিলেন। ঘরবাড়ি করতে পারছিলেন না। এসব সমস্যা সমাধানের জন্যই কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে। আট বছরেও ড্যাপ চূড়ান্ত না হওয়া সম্পর্কে এই মন্ত্রী বলেন, ড্যাপ নিয়ে অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে। তাই সময় লেগেছে। তবে দ্রুত ড্যাপ চূড়ান্ত করা উচিত।

সার্বিক বিষয়ে নগর গবেষণাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং ড্যাপ প্রণয়নের সময় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব সময় মূল ড্যাপের পক্ষেই কথা বলব। তবে এখন একটা শক্তিশালী কমিটি সংশোধনীগুলো আনছে। তাই ১৫ থেকে ২০ বছর পর এর যে ফলাফল দাঁড়াবে, তার দায় এদেরই নিতে হবে।’