কাতারে ৭০ বাংলাদেশির মানবেতর জীবন

বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য যায়। প্রথম আলো ফাইল ছবি
বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য যায়। প্রথম আলো ফাইল ছবি

‘দেশে ফিরে গিয়ে এক বেলা খামু, আরেক বেলা না খাইয়া থাকুম, তারপরও এখানে থাকতে চাই না। এখানে না পারছি খাইতে, না পারছি ঘুমাইতে। এভাবে থাকলে মইরা যামু।’ কাঁদতে কাঁদতে টেলিফোনে প্রথম আলোর কাছে এসব কথা বলছিলেন বাংলাদেশি তরুণ শাহীন মিয়া। টাঙ্গাইলের এই তরুণ এখন কাতারপ্রবাসী। দীর্ঘদিন বেতন না পেয়ে সেখানে মানবেতর জীবন কাটছে তাঁর।

শুধু শাহীন নয়, তাঁর মতো অন্তত ৭০ জন বাংলাদেশি তরুণের একই অবস্থা। আজ সোমবার দুপুরের অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। কথা বলতে গিয়ে সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। তাঁরা দেশে ফেরার আকুতি জানাচ্ছিলেন। তাঁরা জানান, কাতারের খালিজ সোয়ান গ্রুপে ক্লিনার হিসেবে প্রায় দুবছর আগে সেখানে গিয়েছিলেন। বেতন নির্ধারিত ছিল ৯০০ রিয়াল। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর থেকে পাসপোর্ট কোম্পানির কাছে জমা থাকলেও তাঁদের কোনো কাগজপত্র দেওয়া হয়নি। মাঝেমধ্যে তাঁদের কিছু টাকা দেওয়া হতো খাবারের জন্য। কিন্তু গত সাত–আট মাস থেকে কোনো টাকাই পাচ্ছেন না তাঁরা। মানবেতর জীবনযাপনে অতিষ্ঠ এসব তরুণ এখন দেশে ফিরতে চাইলেও পাসপোর্ট ফেরত পাচ্ছেন না।

ময়মনসিংহের বাটাজোর এলাকার মনির হোসেন প্রায় চার লাখ টাকা ব্যয় করে কাতার যান। তিনি বলেন, সেখানে গিয়ে প্রথম কয়েক মাস কাজ ছিল। তবে বেতন পেয়েছেন ছয় থেকে সাত শ রিয়াল। এরপর থেকে অনিয়মিতভাবে টাকা পেয়েছেন। কিন্তু গত সাত মাস ধরে কোনো টাকাই পাচ্ছেন না। একই তথ্য জানালেন গাজীপুরের মো. রাজীব। এসব তরুণের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খালিজ সোয়ান গ্রুপের নিজেদের কোনো কাজ নেই। সেখানকার কিছু প্রতিষ্ঠানের তাঁদের কাজে লাগানো হয়। কাজ না থাকলে শ্রমিকেরা বেকার। প্রতিষ্ঠানটির মূল ব্যবসা হলো ভিসার। তাঁরা বাংলাদেশের দালালদের কাছে আট থেকে নয় হাজার রিয়ালে ভিসা বিক্রি করে। সেসব ভিসা ব্যবহার করে জনশক্তি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে লোক নিয়ে যায় কাতারে। সেখানে গিয়ে ওই সব তরুণ বিপাকে পড়েন। তাঁরা না পান কাজ, না পান বেতন। চার লাখের বেশি টাকা ব্যয় করে সেখানে গিয়ে যাপন করতে হয় মানবেতর জীবন।

এ অবস্থায় এসব তরুণের পরিবারগুলোও উদ্বিগ্ন রয়েছে। যেসব দালালের মাধ্যমে তাঁরা বিদেশ গেছেন, তাঁদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন নিজেদের সন্তানদের ফেরত আনতে। কেউ বা ধরনা দিচ্ছেন জনশক্তি ব্যবসায়ীদের কাছে। নিজের টাকাতেই ফেরত আনতেও রাজি তাঁরা। তারপরও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এলাকার বাসিন্দা মুক্তি জানালেন, তাঁর ছেলে তৌহিদ হোসেনকে চার লাখ টাকা খরচ করে কাতার পাঠিয়েছিলেন। এখন প্রতিদিন ছেলের কষ্টের কথা আর কান্না শুনে তাঁকে ফেরত আনার চেষ্টা করছেন। দালালেরা আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই।

জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো কাজ না থাকলেও গত এক মাসের মধ্যে আরও অন্তত ২০ জন কর্মী গেছেন ওই প্রতিষ্ঠানে, সেখানে গিয়েই তাঁরা বুঝতে পেরেছেন তাঁদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির বিষয়গুলো। এসব বিষয়ে জানতে কাতারে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) মোহাম্মদ রবিউল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় জানতে চান। তিনি বলেন, খোঁজখবর নিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নমিতা হালদার এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে কাতারপ্রবাসী এসব তরুণের অভিযোগ, যাঁরা খালিজ সোয়ান গ্রুপে কর্মী পাঠাচ্ছেন, তাঁরা নিজেরাও জানেন প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে। এখন সরকার যদি এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে তাঁদের মতো আরও অনেকে এ চক্রে আটকে যাবে। তাই কাতারে মানবেতর অবস্থা থেকে তাঁদের ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি ওই প্রতিষ্ঠানটিতে লোক পাঠানো বন্ধের জোরালো উদ্যোগ নেওয়ার দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা।