যে আইনে ড্যাপ, সেই আইনই লঙ্ঘন হচ্ছে

ড্যাপ কার্যকর থাকলে জমির শ্রেণি পরিবর্তনের এখতিয়ার শুধু রাজউকের। অন্য কেউ করলে নগর উন্নয়ন আইনের লঙ্ঘন হবে। রাজউকের চেয়ারম্যান জানান, ড্যাপ কার্যকর আছে।

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড্যাপ কার্যকর থাকলে জমির শ্রেণি পরিবর্তনের এখতিয়ার শুধু রাজউকের। অন্য কেউ এ কাজ করলে সেটি নগর উন্নয়ন আইনের লঙ্ঘন হবে।

ড্যাপ কার্যকর আছে কি না জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অবশ্যই কার্যকর আছে।

নগর উন্নয়ন আইনের ৭৩-এর ১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, রাজউক তার এখতিয়ারভুক্ত এলাকার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) তৈরি করবে; যাতে কোন জমি কীভাবে ব্যবহৃত হবে তা নির্দিষ্ট করা থাকবে। এই আইনে ২০০৪ সালে ড্যাপ প্রণয়নের কাজ শুরু করে রাজউক। ২০০৬ সালে এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ হয় ২০০৭ সালে। এরপর পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ড্যাপের ওপর মতামত নেয় সংস্থাটি। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও ড্যাপ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত ছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে ড্যাপ চূড়ান্ত করা হয়।

নগর উন্নয়ন আইনের ৭৩-এর ৩ ধারা অনুযায়ী ২০১০ সালের ২২ জুন ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এ সময় আবাসন প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা ড্যাপে ভুল আছে বলে বিতর্ক শুরু করেন।

নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, নগর উন্নয়ন আইনেই এই বিতর্ক নিষ্পত্তির সুযোগ ছিল। এই আইনের ৭৩-এর ৪ ও ৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, পরিকল্পনা প্রকাশের পরের ৬০ দিন পর্যন্ত এ নিয়ে সরকারের কাছে আপত্তি জানানো যাবে। আপত্তিগুলো বিবেচনা করে মাস্টারপ্ল্যানটি পরিবর্তন করে অথবা না করে পরবর্তী চার মাসের মধ্যে এটি অনুমোদন দেবে সরকার।

আইনের ৭৫ ধারা অনুযায়ী, সরকার অনুমোদন দেওয়ার পরও কারও কারও আপত্তি থাকলে রাজউকের চেয়ারম্যান বরাবর আবার আবেদন করা যাবে। রাজউকের চেয়ারম্যান আবেদনটির অনুমোদন না দিলে রাজউকের বোর্ড বরাবর আপিল করা যাবে। এরপর বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।

এই প্রক্রিয়ায় না গিয়ে ড্যাপের গেজেট প্রকাশের ছয় দিনের মাথায় আরেকটি গেজেট প্রকাশ করে সরকার ড্যাপ আরও বিশদভাবে পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করার জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে। কমিটির কাজ কী হবে, সেটিও স্পষ্ট করে গেজেটে উল্লেখ করা হয়।

কমিটিকে জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শ, ওয়েবসাইট ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত মতামত এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের মতামত পর্যালোচনা করে ড্যাপ চূড়ান্ত করতে বলা হয়। তবে কত দিনের মধ্যে এটি চূড়ান্ত করতে হবে তা বলা হয়নি। এ অবস্থায় গত আট বছরেও কমিটি ড্যাপ চূড়ান্ত করেনি। কিন্তু এই সময়ে কমিটি একটি একটি করে আবেদন ধরে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করছে।

জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, আইন অনুযায়ী এটি (শ্রেণি পরিবর্তন) রাজউকের ক্ষমতা ঠিক আছে। তারপরও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া খারাপ হয়নি। মন্ত্রিসভা কমিটিও জানুক ড্যাপের কোথায় ভুল ছিল। কমিটি ঠিক মনে করলে অনুমোদন দেবে, না মনে করলে দেবে না।

জানা গেছে, মন্ত্রিসভা কমিটি ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয় মূলত ড্যাপ সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত আরেকটি কারিগরি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে। ২০১৩ সালের ১৯ মে মন্ত্রিসভা কমিটির দ্বিতীয় সভায় ড্যাপের ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদনগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্যসচিব হচ্ছেন রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম।

ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য রাজউক ও মন্ত্রণালয়ে করা আবেদনগুলো প্রথমে সিরাজুল ইসলামের দপ্তরে যায়। তাঁর নেতৃত্বেই হয় প্রাথমিক যাচাই-বাছাই। তারপর বাছাই করা আবেদনগুলো ওঠে কারিগরি কমিটির সভায়। সেখানে দ্বিতীয় পর্যায়ের যাচাই-বাছাই শেষে আসে মন্ত্রিসভা কমিটিতে।

২০১৬ সালের ১ আগস্ট মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে একটি আবেদন নিয়ে কারিগরি কমিটির এক সদস্য তোপের মুখে পড়েছিলেন। কারণ কারিগরি কমিটি যথাযথভাবে তথ্য যাচাই-বাছাই না করে মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে ভূমি পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিল।

কারিগরি কমিটির এক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, মন্ত্রিসভা কমিটির সভা হয় এক-দুই ঘণ্টার মতো। এত অল্প সময়ে মন্ত্রিসভা কমিটির সব খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয় না।

ড্যাপ সংশোধন ও কারিগরি কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে কমিটির সদস্যসচিব ও রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাঁর কার্যালয়ে যেতে বলেন। পরদিন কার্যালয়ে গেলে তিনি ড্যাপ নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়ে দেন।

এখন পর্যন্ত আনা সব সংশোধনীই কি ড্যাপে ভুলের কারণে হয়েছে—জানতে চাইলে ড্যাপ চূড়ান্তকরণে গঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্য বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘সবই ড্যাপের ভুল সংশোধন বলব না। তবে কিছু জায়গায় বৃষ্টির পানি জমলেও সেগুলো ড্যাপে জলাধার দেখানো হয়েছিল। এসব সংশোধন করা হয়েছে।’

নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভুল থাকলে তা নগর উন্নয়ন আইনের মাধ্যমেই সংশোধনের সুযোগ ছিল। তা না করে যে কমিটি করা হয়েছে, তার আইনগত ভিত্তি দুর্বল।