পোশাকশিল্পের নিরাপত্তার গলায় কাঁটা ১ হাজার ৪৬৩ কারখানা

দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা দুর্বল, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সাভারে রানা প্লাজা ধস। দেশের সবচেয়ে বড় সেই শিল্প দুর্ঘটনার পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। এখনো পোশাকশিল্পের নিরাপত্তার গলায় কাঁটা হয়ে আছে ১ হাজার ৪৬৩ কারখানা।

সাভারে ভবন ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের বিশেষ ব্যবস্থায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও সেটিকে আইনি কাঠামোতে আনা যায়নি। অন্যদিকে মামলা চলমান থাকলেও রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত দোষীদের কেউ শাস্তি পাননি। সেই ভবনের পাঁচ পোশাক কারখানার মালিকেরা জামিনে আছেন।

ওই দেড় হাজার কারখানার মধ্যে জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) অধীনের পরিদর্শন কার্যক্রমে ৮০৯ পোশাক কারখানার অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। তবে ত্রুটিগুলো সংস্কারে কারখানার মালিকেরা গড়িমসি করছেন। ফলে দুই বছরের বেশি সময় পার হলেও মাত্র ২৭ শতাংশ ত্রুটি সংশোধনকাজ শেষ হয়েছে। অন্যদিকে ৬৫৪ কারখানাকে পরিদর্শন কার্যক্রমের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। পোশাকশিল্পের মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য না হওয়ায় এই কারখানাগুলোর দায়দায়িত্ব কেউই নিচ্ছে না। সব মিলিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের নিরাপত্তাব্যবস্থায় এখনো বড় রকমের ত্রুটি রয়ে গেছে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় দুই পা হারিয়ে মাটির এই ঘর আর বারান্দাতেই দিন কাটে রেবেকা খাতুনের। সম্প্রতি দিনাজপুরে রেবেকার বাড়িতে।  ছবি: মঈনুল ইসলাম
রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় দুই পা হারিয়ে মাটির এই ঘর আর বারান্দাতেই দিন কাটে রেবেকা খাতুনের। সম্প্রতি দিনাজপুরে রেবেকার বাড়িতে। ছবি: মঈনুল ইসলাম

ব্যবসা হারানোর ভয় থাকায় ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের অধীনে থাকা ২ হাজার ২৯৫ কারখানার ত্রুটি সংশোধনকাজে ভালো অগ্রগতি হয়েছে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ডের সদস্য ১ হাজার ৬৩১ কারখানার অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত ত্রুটির ৮৩ শতাংশ সংশোধন কাজ শেষ। তার মধ্যে ৬৯৯ কারখানার ত্রুটির সংশোধন কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯০ শতাংশ। অন্যদিকে উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্সের ৬৬৪ কারখানার ত্রুটির ৮৯ শতাংশ সংশোধনকাজ শেষ করেছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহায়তায় এনটিএপির কার্যক্রমের দেখভাল করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)। সংস্থাটির মহাপরিদর্শক শামসুজ্জামান ভূঁইয়া গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ত্রুটি সংশোধন কাজ না করায় কারখানাগুলোতে নিরাপত্তাঝুঁকি রয়ে গেছে। আমরা বহুবার মালিকদের চিঠি দিয়ে তাগিদ দিয়েছি। কাজ হয়নি। তাই কোনো কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটলে তার সমস্ত দায়দায়িত্ব মালিকদেরই নিতে হবে।’

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অল্প কিছু কারখানার জন্য পুরো পোশাকশিল্পকে হুমকির মুখে ফেলা যাবে না। তাই যারা কাজ করবে না, তাদের সঙ্গে আমরা নেই। তবে যারা কাজ করবে, তাদের সহায়তা করা হবে।’ তিনি বলেন, ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানাগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া আছে। তারপর অগ্রগতি দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল পৌনে ৯টায় সাভারে ৯ তলা রানা প্লাজা ধসে পড়ে। এ ঘটনায় ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৮ (বিজিএমইএর সর্বশেষ হিসাব) শ্রমিক মারা যান। আহত হন সহস্রাধিক শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে অঙ্গ হারান ২৭ জন।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত শ্রমিক পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দিতে গঠিত হয় রানা প্লাজা ডোনারস ট্রাস্ট ফান্ড। তহবিলের অর্থ থেকে ভুক্তভোগী ৩ হাজার ১২০ জনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তাতে সর্বোচ্চ একজন নিহতের পরিবারের সদস্যরা পান ৭৮ লাখ টাকা। ২৫ লাখ টাকা করে পান ৬১ নিহত শ্রমিকের পরিবার। নিহত শ্রমিকের পরিবার সর্বনিম্ন হলেও ১০ লাখ টাকা করে পেয়েছেন। আহত শ্রমিকেরাও বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ পান।

২৫০ কারখানা কোনো কাজই করেনি
জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার অধীনে প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ৫৪৯ পোশাক কারখানার পরিদর্শন ২০১৫ সালের নভেম্বরে শেষ করে ডিআইএফই। এসব কারখানার কোনোটিই শতভাগ ত্রুটিমুক্ত নয়। সব কারখানাতেই নিরাপত্তাঝুঁকি আছে।

জানা যায়, ১ হাজার ৫৪৯ কারখানার মধ্যে ৫৩১ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের অধীনে চলে গেছে ১২৯টি। অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে ৬৮ কারখানা। বাকি ৮০৯ কারখানার মধ্যে গত মার্চ পর্যন্ত ২৫০টি কোনো ধরনের ত্রুটি সংশোধনের কাজই করেনি। বাকি ৬৮০ কারখানা গড়ে ২৭ শতাংশ ত্রুটি সংশোধনের কাজ করেছে। অন্যদিকে ১৬৩ কারখানা ভবনের বিস্তারিত প্রকৌশল মূল্যায়ন (ডিইএ) করার কথা থাকলেও হয়েছে মাত্র ৬৭টি।

জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শামসুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘মালিকদের অনীহার কারণেই সংস্কারকাজে অগ্রগতি কম। তা ছাড়া এসব কারখানা যেসব বিদেশি ক্রেতার কাজ করে, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তাই মালিকদের মধ্যে ব্যবসা হারানোর ভয়ও নেই।’

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ৩৭ শতাংশ পোশাক কারখানা পিছিয়ে আছে। এগুলোর মধ্যে ২২ শতাংশ কারখানা সংশোধনের কাজই শুরু করেনি। এটা পোশাকশিল্পের জন্য ভালো কোনো খবর নয়। যেকোনো একটি দুর্ঘটনা সব ইতিবাচক অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

ক্ষতিপূরণের মামলা আটকে আছে তিন বছর
রানা প্লাজা ধসের পরপরই আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ (ব্লাস্ট) কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে চারটি রিট আবেদন করে। একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি রুল দেন।

রুল শুনানির একপর্যায়ে উচ্চ আদালত বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা নয়, অপরাধ। এ জন্য আইন অনুসারে দোষীদের যেমন ফৌজদারি অপরাধের বিচার হতে হবে, তেমনি দোষীদের অপরাধের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তখন রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির মাত্রা ও ক্ষতিপূরণের হার নির্ধারণ করতে আদালত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন। ২০১৩ সালের আগস্টে ১৪ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি ক্ষতিপূরণের হার নির্ধারণ করে ২০১৫ সালের এপ্রিলে একটি প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়। এতে বলা হয়, ভবন ধসের ঘটনায় নিহত, নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার ও স্থায়ীভাবে পঙ্গু হওয়া শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ সাড়ে ১৪ লাখ এবং আহত শ্রমিক পাবেন দেড় লাখ থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা। তবে বিজিএমইএ শুরু থেকেই এটির বিপক্ষে অবস্থান নেয়।

বর্তমানে শ্রম আইনে দুর্ঘটনায় মৃত শ্রমিকের জন্য তাঁর পরিবার এক লাখ টাকা এবং স্থায়ীভাবে অক্ষম শ্রমিকের জন্য ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা আছে। তা ছাড়া সম্প্রতি শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে কিছু অর্থসহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি আবদুর রবের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি জমা পড়ে। কিছুদিন পর হাইকোর্টের বেঞ্চ পুনর্গঠন করা হয়। তারপর তিন বছর পর হলেও বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টের অন্য কোনো বেঞ্চে শুনানি হয়নি। তবে আদালতের ছুটি শেষে মামলাটি সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে গত রোববার প্রথম আলোকে জানান রিট আবেদনকারী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী সারা হোসেন।

জানতে চাইলে শ্রমিকনেতা আমিরুল হক বলেন, উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনাটি এলে সেটি ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে যেত। তখন শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের হারটি একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছে যেত।