চিংড়ির জমিতে গোলপাতা

জমিতে গোলপাতার চাষ করেছেন একসময়ের দুর্ধর্ষ বাওয়ালি খয়বার সরদার।  ছবি: লেখক
জমিতে গোলপাতার চাষ করেছেন একসময়ের দুর্ধর্ষ বাওয়ালি খয়বার সরদার। ছবি: লেখক

সুন্দরবনের কয়রা উপজেলার আমাদি ইউনিয়নের বেশ বড় গ্রাম নাকসা। খুলনা শহরেই কয়েকজনের কাছে শুনলাম, কয়রা উপজেলায় কিছু মানুষ চিংড়ি চাষের পরিবর্তে গোলপাতার চাষ করছেন। গোলপাতা যেহেতু জলে গোড়া ভিজিয়ে জন্মায়, চাষিরা এর সঙ্গে সাদা মাছের (পারশে, দাতিনা, খয়রা, পাতারি ইত্যাদি মাছকে স্থানীয় ব্যক্তিরা সাদা মাছ বলেন) চাষও করছেন।

খুলনায় পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ‘ক্লীন’-এর প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী ও পরিচালক সাজ্জাদ হোসেনকে নিয়ে খুলনা থেকে নাকসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। হাসান, সাজ্জাদ-দুজনেরই উৎসাহ গাছপালা নিয়ে।
একে সরু রাস্তা, তার ওপর অর্ধেক পথই ভাঙা। দুই পাশের শয়ে শয়ে চিংড়িঘের দেখতে দেখতে তিন ঘণ্টায় নাকসা গ্রামে পৌঁছালাম। খয়বার সরদার বাওয়ালির কথা আগেই শুনেছিলাম। চিংড়ির বদলে গোলপাতা চাষের উদ্যোক্তা তিনিই। এই এলাকার বিচারে ব্যাপারটি অভিনব। যেখানে বসতবাড়ি ছাড়া মাঠে কোথাও এক বিন্দু সবুজের ছোঁয়া নেই, মাইলের পর মাইল বিবর্ণ জলাধার-যেখানে চিংড়ি নিয়ে আসে নগদ নারায়ণ, সেখানে সামান্য মানুষটি কী করে গোলপাতার চাষ শুরু করেন, কী করে সেটা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন, সেটা দেখতেই আমাদের নাকসায় ছুটে আসা।
আশি বছরের এই প্রান্তিক চাষির পৈতৃক পেশা সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ বাওয়ালিগিরি। গোলপাতা আর গরান কাটায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আশপাশের মানুষ জানালেন, সৎ ও সাহসী বাওয়ালি হিসেবে খয়বার সরদারের খুব সুনাম ছিল। বাওয়ালির কাজ ছাড়া আরও একটি কাজ করতেন তিনি। দুঃসাহসিক কাজ। বাঘে মানুষ নিয়ে গেলে সেই মানুষের লাশ ছাড়িয়ে আনতেন বাঘ তাড়িয়ে। বছর পাঁচেক আগে বাওয়ালির কাজে ইস্তফা দেওয়ার আগে তাঁর ষাট বছরের বনজীবনে মোট ১৩ জন মানুষ ছাড়িয়ে এনেছেন।
বাবা সিরাজ সরদারের হাত ধরে মরা সুন্দরী, মরা গরান কাটা দিয়ে শুরু হয় বাওয়ালির কাজ। সারা বছরই বাদায় কাজ থাকত। কাশিয়াবাদ, কালাবাগী, কয়রা বন অফিস থেকে পাস নিয়ে বাদা কাটায় নামতেন।
গোলগাছ বোনা মাথায় এল কীভাবে, জিজ্ঞেস করায় বললেন, ‘বয়স হয়ে গিয়েছে, বাদায় আর কাজ করতে পারছি না। ভাবলাম এইবার আর না। বাড়ি আসার সময় চার কাঁদি গোল ফল নিয়ে এসেছিলাম সঙ্গে করে। দশ কাঠার মতো জমি আছে আমার। সেই জমিতে বাঁধ দিয়ে জল আটকালাম। কাঁকড়ার গর্ত বোজালাম, তারপর গোল ফল পুঁতে দিলাম। সারা বছর হাঁটুজল থাকে এই খেতে। এখানে সাদা মাছ দিলাম। মাছের বৃদ্ধি ভালো হয় গোলগাছের শেওলা খেয়ে। গোলগাছের বয়স তিন বছর হওয়ার পর পাতা কাটা যেতে পারে।’
গোলঝাড়ের মাঝখানের পাতাটা (মাইজপাতা) গোলাকার হয় বলে এই পাতার নাম গোলপাতা। মাইজপাতা আর পাশের পাতা রেখে বাকি পাতা কেটে ফেলি। তাতে বছরে দুই-আড়াই কাহন পাতা হয় (৮০টি পাতায় ১ পণ, ১৬ পণে ১ কাহন) সাত-আট হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সাদা মাছ থেকেও পাঁচ-ছয় হাজার টাকা সংস্থান হয়।
খয়বার সরদার বলেন, বনের গোলপাতা কাটতেই হবে। গোলপাতা বেশি দিন কাটা না হলে পাতা নষ্ট হয়ে যায়, পোকা ধরে।