রোহিঙ্গাদের এক ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে আরেক ঝুঁকি তৈরি করা হচ্ছে

কুতুপালংয়ে একটি রোহিঙ্গা পরিবার।  ফাইল ছবি
কুতুপালংয়ে একটি রোহিঙ্গা পরিবার। ফাইল ছবি
>
  • রোহিঙ্গারা দ্রুত ফেরত যাচ্ছে না।
  • বর্ষা আসছে, আতঙ্কে রোহিঙ্গারা।
  • রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে।
  • আবার কাটা হচ্ছে পাহাড়, উজাড় হচ্ছে বনভূমি।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চুক্তি সইয়ের পাঁচ মাস পরও মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাখাইনে ফেরত পাঠানোতে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অথচ বর্ষা মৌসুম ঘনিয়ে আসায় ভূমিধস, সাইক্লোন, অতিবৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা বেড়েছে। এ অবস্থায় পাহাড় কেটে, নিচু জায়গা ভরাট করে, নতুন করে বনভূমি এলাকা বরাদ্দ দিয়ে রোহিঙ্গাদের রাখার জায়গা করা হচ্ছে। এতে এক ঝুঁকি থেকে বাঁচতে আরেক ঝুঁকি তৈরি করা হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে প্রকৃতির, পরিবেশের।

গতকাল বৃহস্পতিবার উখিয়ার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শনের সময় পুনর্বাসনের এই তোড়জোড় চোখে পড়েছে। সকালে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের পশ্চিম পাশের এলাকাগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, বর্ষায় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে বেশ কয়েকটি পাহাড় কেটে সমতল ও নিচু জায়গাগুলো ভরাটের কাজ চলছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে নতুন করে আরও ৫৪০ একর বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান প্রথম আলোকে জানান, উখিয়ায় আগে ২০টি শিবির ছিল। বর্তমানে বাড়িয়ে ৩০টি করা হয়েছে। কুতুপালং থেকে থাইংখালী পর্যন্ত বিস্তৃত বৃহদায়তন এলাকায় আছে এসব শিবির। বন বিভাগ এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য ৫ হাজার ৮০০ একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে। জানা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা দ্রুত শেষ করতে সরকারের উচ্চপর্যায় এবং স্থানীয় পর্যায় থেকেও তাগিদ দেওয়া হয়েছে। 

আসছেন নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধি
এদিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কয়েকবার বৈঠক ও বিবৃতি প্রচারের পর এবার সরেজমিনে তাদের অবস্থা দেখতে বাংলাদেশে আসছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল। কাল শনিবার ঢাকায় নেমেই প্রতিনিধিদলটি কক্সবাজারে আসবে। দুই দিন এখানকার পরিস্থিতি দেখে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলটির সোমবার মিয়ানমার যাওয়ার কথা রয়েছে। সহিংসতার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা পরিষদ এই প্রথমবারের মতো এই অঞ্চল সফর করবে। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার একটি টেকসই সমাধানে এই সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল।

বর্ষার প্রস্তুতি
বর্ষা মৌসুম নিয়ে আতঙ্কে আছে রোহিঙ্গারাও। পাহাড়ের ওপরে ত্রিপলের ছাউনি ও বাঁশ-পলিথিনে ঘেরা ঘরগুলো নিরাপদ নয়। ফলে পরিবার-পরিজনসহ ঝড়বৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ে উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তায় আছে প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার।

কুতুপালং ডি-৪ শিবিরের বাসিন্দা মোমেনা খাতুন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘কী আর করা। নিজের জন্মভূমি ছেড়ে আসতে হয়েছে। বর্ষাকাল শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। এর মধ্যে ঘরগুলো আরও শক্ত করে বেঁধে দিলে অন্তত দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারতাম।’

মূলত শিবিরে বসবাসরত লাখ লাখ রোহিঙ্গাই আসন্ন বর্ষা মৌসুমে বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এখানে অধিকাংশ ঘর তোলা হয়েছে পাহাড়ের ঢালুতে। ভারী বৃষ্টিতে আছে ভূমিধসের ভয়। আর নিম্নাঞ্চলে বন্যায় প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি।

রোহিঙ্গাদের জন্য প্রথম দিকে ৩ হাজার একর ও পরে ২ হাজার ৮০০ একরসহ বিশাল বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া জমিতে ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গা বসতিগুলো সরিয়ে নেওয়া হবে।

উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা লাইলা খাতুন বলেন, পাহাড়ে কখনো থাকতে হয়নি। এখন বাধ্য হয়ে পাহাড়ের ঢালুতে ঘর তুলতে হয়েছে। প্রতি রাতে ভয় লাগে যদি ঘরটা ভেঙে পাহাড়ের নিচে পড়ে যায়।

গতকাল সরেজমিনে উখিয়ার বেশ কয়েকটি এলাকায় বিভিন্ন বয়সের রোহিঙ্গাদের লাকড়ি সংগ্রহ করতেও দেখা যায়। ওই সব লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত রান্নার কাজে বন থেকে তারা ওই লাকড়ি সংগ্রহ করে। বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা না থাকায় এখন পর্যন্ত ৫০০ একরের বেশি বনভূমি উজাড় হয়েছে বলে জানাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা।

উখিয়া ঘুরে এসে সংরক্ষিত বন উজাড় করে রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে এক সরকারি কর্মকর্তা গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, এশীয় দুর্যোগ প্রস্তুতিমূলক কেন্দ্র (এডিপিসি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত যৌথ সমীক্ষায় পাহাড়ি ঢল ও ভূমিধসের কারণে এক লাখ রোহিঙ্গার চরম ঝুঁকিতে থাকার উল্লেখ করা আছে। ওই সমীক্ষার পর চরম ঝুঁকিতে থাকা অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গার আবাসনের জন্য পাহাড় কাটতে হয়েছে। এ ছাড়া কুতুপালং-বালুখালী শিবির এলাকা সম্প্রসারণের জন্য প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ করা জমির পরিমাণ দুই হাজার একর থেকে বাড়িয়ে চার হাজার একর করা হয়েছে। এ ছাড়া শুরুতে রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৪ হাজার ঘর তৈরির কথা থাকলেও পরে ঘরের সংখ্যা দুই লাখ করা হয়েছে।

কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরের বসতিগুলো দ্রুত স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বর্ষায় ভূমিধস ঠেকাতে তাদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন এসব নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সামনে বর্ষা মৌসুমে বন্যা, ভূমিধস, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। এতে দুর্যোগে পড়তে পারে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। তাদের সরিয়ে নিতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন (আরআরআরসি), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারসহ (ইউএনএইচসিআর) বিভিন্ন সংস্থা যৌথভাবে কাজ করছে। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পশ্চিম পাশেই এই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। চিহ্নিত রোহিঙ্গা বসতিগুলো খুব দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হবে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তার নামে গাছপালা লুট করা হয়েছে। প্রকৃতিকে স্থায়ীভাবে ধ্বংস করা হলো। এখানে না রেখে টেকনাফ এলাকায় যে বেড়িবাঁধ আছে, সেটা মজবুত করে পাশের সমতলভূমিতে রোহিঙ্গাদের রাখা উচিত ছিল। তা না করে কোনো ধরনের পরিবেশ সমীক্ষা ও ভূতাত্ত্বিক জরিপ ছাড়াই পাহাড় ও বন কেটে সমান করে ওই এলাকার ভূ-প্রকৃতির স্থায়ী ক্ষতি করা হলো। এটা অন্যায়, মানা যায় না। প্রকৃতির এত বড় ক্ষতি করার অধিকার সরকারের নেই।

গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো হয়। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় সাত লাখ মানুষ। গত বছরের নভেম্বরে সই হওয়া প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরানোর কথা থাকলেও তাতে তেমন অগ্রগতি নেই।