জঙ্গিদের সংশোধনের ব্যবস্থা নেই বাংলাদেশের কারাগারগুলোয়

>
  • উগ্র মতাদর্শ থেকে ফিরিয়ে আনার কোনো কর্মসূচি নেই
  • ছোট জঙ্গিরা আরও বড় জঙ্গি হয়ে বেরিয়ে আসছেন।

বাংলাদেশের কারাগারগুলোয় জঙ্গিদের সংশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে যে মতাদর্শের কারণে কোনো ব্যক্তি জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছেন, তিনি যখন কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছেন, তখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই মতাদর্শের অনুসারীই থেকে যাচ্ছেন বা আরও বড় জঙ্গি হয়ে বেরিয়ে আসছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা ও গবেষকেরা কারাগারে ডির‍্যাডিক্যালাইজেশন বা উগ্র মতাদর্শ থেকে ফিরিয়ে আনার কর্মসূচির ওপর গুরুত্বারোপ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের কারাগারে সংশোধনমূলক কোনো কর্মসূচি নেই। এ ধরনের কোনো কর্মসূচি চালুর কোনো প্রস্তুতিও নেই।

কারাগার থেকে বেরিয়ে আরও বড় জঙ্গি হয়ে ওঠার উদাহরণ হিসেবে পুলিশ সারওয়ার জাহানের কথা বলছে। জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের সহযোগী সারওয়ার জাহান ২০০৩ সালে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হন। নয় মাস কারাগারে ছিলেন। এরপর এক যুগ তিনি কী করেছেন সে সম্পর্কে পুলিশের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর জানা যায়, এই সারওয়ার জাহান আইএসপন্থী নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত এবং হোলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিতে জড়িত। আনসারুল্লাহর জুন্নুন শিকদার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ২০১৩ সালে। জামিনে মুক্ত হয়ে দেশ ছাড়েন। তিনি আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করতে সিরিয়ায় গেছেন বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩ হাজার সন্দেহভাজন জঙ্গি গ্রেপ্তার হন। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৩৩০ জন জামিনে মুক্তি পান।
বাংলাদেশ পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গিদের জামিনে ঝুঁকি রয়েছে। কারণ কারাগারে ডির‍্যাডিক্যালাইজেশন এবং পরে পুনর্বাসনের সুযোগ না থাকলে যে উগ্রবাদী মতাদর্শ নিয়ে একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং কারাগারে ঢুকেছেন, তিনি ওই অবস্থাতেই বেরিয়ে আসবেন।

কারাগারের পরিস্থিতি কী?
দেশের ৬৮টি কারাগারে এখন জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার আছেন ৬০০ আসামি। কারা অধিদপ্তর জানিয়েছে, পুলিশ পূর্ণাঙ্গ তথ্যসহ আসামি কারাগারে পাঠানোর পর কারা কর্তৃপক্ষ যে ব্যক্তি যে দলের প্রতি অনুগত, তাঁকে তাঁদের সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করেন।

গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কারাগারের একটি সূত্র বলেছে, জঙ্গিদের জন্য প্রায় এক ডজন ভবন আছে। যে ব্যক্তি জেএমবির অনুসারী, তাঁকে জেএমবির জন্য নির্ধারিত ভবনের নির্ধারিত তলায় বা সেলে রাখা হয়। একই ব্যবস্থা আনসার আল ইসলাম, হরকাতুল জিহাদ বা অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর অনুসারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে এক তলা থেকে অন্য তলায় বা এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আছে। 

কারাগারে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা কী করেন? পুলিশের সদ্য সাবেক একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে বন্দী থাকা শীর্ষস্থানীয় নেতারা কারাগারের ভেতরে তাঁদের কার্যক্রম সচল রাখেন। তাঁরা কারারক্ষীদের মুঠোফোন ব্যবহার করে বাইরে যোগাযোগ করেন, কারাগারের ভেতরে অনুসারীদের বিভিন্ন বার্তা পাঠান, আদালতে যখন হাজিরা দিতে যান, তখন কারারক্ষীদের মাধ্যমে খবরাখবর পৌঁছান। উদাহরণ হিসেবে তিনি ফাঁসি হওয়া হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানের প্রসঙ্গ টানেন। কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাঁকে (হান্নান) ছিনিয়ে নেওয়ার নির্দেশ তিনি কারাগারে নিজের সেলে বসেই মুঠোফোনে দিয়েছিলেন। বিষয়টি পুলিশ টের পেয়ে যায় এবং তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার জঙ্গি সালেহ আহমেদ আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতেও এ কথা বলেন। আইএসের বিভিন্ন প্রচারপত্র কারাগারের ভেতরে অনুবাদ হওয়ার তথ্যও কারা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কারাগারে ছিলেন জামিনে মুক্ত এমন পাঁচ ব্যক্তির সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলছেন, কারগারে যেহেতু ডির‍্যাডিক্যালাইজেশন বা সংশোধনের কোনো কর্মসূচি নেই, যাঁদের সম্পৃক্ততা কম তাঁদের জঙ্গিরা উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ পাচ্ছেন।

জামিনে মুক্ত এক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, তিনিসহ আরও বেশ কয়েকজন জেএমবির অনুসারী ছিলেন না। ভাগ্যের ফেরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জ কারাগারে তাঁকে জেএমবির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে রাখা হয়েছিল। ওই জায়গায় জেএমবির নেতা-কর্মীদের কথাই শেষ কথা। তাঁরা নিয়মিত জিহাদ, হারাম, হালাল ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করতেন। অনেকে এতে প্রভাবিতও হন। তিনি বলেন, কারাগারে দাবা খেলার টুর্নামেন্ট করার উদ্যোগ নিলে জেএমবির ওই নেতারা তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেন।

জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে অনেক দিন কারাগারে ছিলেন এমন একজন জামিনে মুক্ত হয়ে এখন পুলিশের বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গিরা ভুল মতাদর্শে পরিচালিত। তাঁদের ওপর কঠোর না হয়ে সঠিক মতাদর্শ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে মারাত্মক নির্যাতনের অভিযোগ করতেন। কারাগারে থাকা অন্য আসামিরা তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন এবং রাষ্ট্রকে প্রতিপক্ষ মনে করেন।

কারা কর্তৃপক্ষ যা বলছে
কারা মহাপরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন আহমেদ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, জঙ্গিরা যিনি যে দলের, সেই দলে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। অন্যদের নিজেদের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, প্রত্যেক বন্দীকে আলাদা রাখার সুযোগ নেই। তবে যাঁদের সম্পৃক্ততা কম, তাঁদের আলাদা রাখার চেষ্টা করা হয়।

কারাগারে ডির‍্যাডিক্যালাইজেশনের উদ্যোগ নেই কেন—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, জঙ্গিরা যেহেতু তথাকথিত আদর্শভিত্তিক ধ্যানধারণা নিয়ে চলেন, তাঁদের সেই ধারণা থেকে বের করে আনতে গেলে পাল্টা যুক্তিসহ বক্তব্য তাঁদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। ৭ হাজার বন্দী ও ৮০০ কারারক্ষী ব্যবস্থাপনার জন্য দুজন কর্মকর্তা আছেন। তাঁদের পক্ষে কাজটি করা জটিল, দক্ষতারও ঘাটতি আছে।
কারা মহাপরিদর্শকের এই যুক্তি ও ব্যাখ্যা তাঁর নিজস্ব, নাকি কোনো গবেষণায় প্রমাণিত, সে বিষয়ে জানা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে জানতে সাক্ষাৎকারের জন্য সময় চেয়ে বেশ কয়েকবার মুঠোফোনে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়েও তাঁর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কারাগারকে সংশোধনাগারে রূপান্তরের কাজ চলছে। তবে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত আলাদাভাবে কোনো কৌশল বা পরিকল্পনা নেই।

কী করা উচিত
গত বছরের মার্চে ঢাকায় পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেররিজম রিসার্চের (আইসিপিভিটিআর) পরিচালক রোহান গুণারত্নে বলেছিলেন, কারাগারগুলোতে ডির‍্যাডিক্যালাইজেশন বা জঙ্গি মতাদর্শ থেকে ফিরিয়ে আনার কাজটি করতে হবে। প্রথমে ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো যাঁরা, তাঁদের যুক্ত করতে হবে। পুলিশের মধ্যেও অনেকে আছেন, যাঁরা ধর্ম সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান রাখেন। তাঁদের কাজে লাগানো যেতে পারে। সবচেয়ে বড় ১০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তাঁদের কর্মমুখী শিক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। তাঁদের এদেশীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার।

পুলিশ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের কারাগারে ডির‍্যাডিক্যালাইজেশনের কাজ চলছে এবং তাঁরা সুফল পাচ্ছেন। ইন্দোনেশিয়ার কারাগারে সংশোধনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের পৃথক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দীক্ষাগুরু, জঙ্গি, জঙ্গিবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল—এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। তাঁরা কারাগারে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা পান। মালয়েশিয়ায় বন্দীরা নিয়মিত ধর্মীয় ক্লাস করেন। তাঁরা ধর্মীয় দীক্ষাগুরুর সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্কের সুযোগ পান, মালয়েশিয়া ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট বছরে দুবার কার্যক্রম মূল্যায়ন করে। জঙ্গিদের স্ত্রী বা স্বামী কারাগারে থাকার সময় তাঁদের যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, সে সম্পর্কে অন্যদের অবহিত করে। সৌদি আরবে অ্যাডভাইজরি কমিটির নেতৃত্বে কারাগারে দেড় শ ধর্মীয় বক্তা ও অধ্যাপক নিয়ে ধর্মীয় উপকমিটি, ৫০ জন মনোবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসককে নিয়ে মনোসামাজিক কমিটি, শিক্ষা উপকরণ তৈরির জন্য মিডিয়া উপকমিটি ও নিরাপত্তা উপকমিটি কাজ করে। ইয়েমেনে বিচারপতি হামুদ আল হিতার সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর নেতৃত্বে কারাগারে ডির‍্যাডিক্যালাইজেশনের কাজ শুরু হয়। কারাবন্দীদের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি ছিল, তাঁরা যদি যুক্তিতে হারাতে পারেন, তাহলে কারাবন্দীরা তাঁদের কথা মেনে নেবেন। ইয়েমেনে জঙ্গিদের অভিযোগ ছিল, রাষ্ট্রে পশ্চিমা হালচালের প্রভাব বেশি। শরিয়াহ আইনের প্রয়োগ নেই। তাঁদের কাছে যখন পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, ইয়েমেনের কোন আইন শরিয়াহ আইনের পরিপন্থী তার জবাব তাঁরা আর দিতে পারেননি। এভাবে ধারাবাহিক কয়েকটি অধিবেশনের পর অনেকেই জঙ্গিবাদের পথ থেকে বেরিয়ে আসে।

গবেষকেরা বলছেন, কারাগারে যদি জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রম চালানো না যায়, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কারাগারকে সংশোধনাগার বলছি। কিন্তু আদর্শিক বিভ্রান্তিতে যারা আছে, তাদের সংশোধনের কোনো উদ্যোগ কারাগারে নেওয়া হচ্ছে না। অভিযানে যতটা বিনিয়োগ করা হচ্ছে, জঙ্গিবাদ থেকে মুক্তির জন্য তেমন উদ্যোগ দরকার।’