গরিবের মামলা বিনা মূল্যে

মাগুরায় জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিনই আসেন বিচারপ্রার্থীরা। গত ২৩ এপ্রিল।  ছবি: প্রথম আলো
মাগুরায় জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিনই আসেন বিচারপ্রার্থীরা। গত ২৩ এপ্রিল। ছবি: প্রথম আলো

বিচারকের এজলাস নয়, তবু বিচারপ্রার্থীদের ভিড়। গত সোমবার (২৩ এপ্রিল) বিকেলে মাগুরা জজ আদালত ভবনের সিঁড়ি ভেঙে উঠতেই নিচতলায় বাঁ পাশে এমন ভিড় দেখে কৌতূহলে উঁকি দিয়ে দেখা গেল, দুই শিশুসন্তানকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন অল্পবয়সী এক নারী। টেবিলের অপর পাশে চেয়ারে বসা এক নারী মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছিলেন। পাশের কক্ষে সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকা আরও ১৫ জনের মতো নারী, পুরুষ ও শিশুর দেখা মিলল।

জানা গেল, এটি লিগ্যাল এইড অফিস। যিনি সমস্যা শুনে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, তিনি লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা সহকারী জজ ইয়াসমিন নাহার।

বিচারক ইয়াসমিন নাহার জানালেন, এই ভিড় নিত্যদিনের। সামনে বসা অসহায় নারীটি দুই শিশুসন্তান নিয়ে স্বামীর ঘরে ফিরতে চান। স্বামী তাঁকে সন্তানসহ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন করেছেন।

রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা খন্দকার খালেদা আকতারের সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল দাম্পত্য টানাপোড়েনে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কোনো চাকরি করেন না। মামলা-মোকদ্দমা চালানোর সামর্থ্য তাঁর ছিল না। টেলিভিশনে ‘গরীবের মামলা চালাবে সরকার’—এমন একটি বিজ্ঞাপন দেখেন। এরপর ঠিকানা সংগ্রহ করে মাকে নিয়ে ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে চলে আসেন। তিনি ভাবতেও পারেননি, একজন বিচারকই লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে তিনি সরাসরি কথা বলছেন।

সরকারের আইনগত সেবা কার্যক্রমের পরিধি সারা দেশে বাড়ছে। এত দিন বিচারপ্রার্থীদের দিক থেকে খুব বেশি সাড়া পাওয়া যেত না, এই সেবার কথা মানুষের জানা ছিল না বলে। কিন্তু প্রচারণার কারণে এখন এটির প্রতি মানুষের সাড়া বাড়ছে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে আজ ২৮ এপ্রিল পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস’।

লিগ্যাল এইড অফিসের কাজ
প্রতিটি জেলায় জজ আদালতে রয়েছে লিগ্যাল এইড অফিস। একজন সহকারী জজ লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জেলা আইনগত সহায়তা প্রদান কমিটি বা লিগ্যাল এইড কমিটির মাধ্যমে এই কার্যালয় পরিচালিত হয়। কমিটিতে রয়েছেন মুখ্য বিচারিক হাকিম, জেলা প্রশাসক, পুলিশ, সিভিল সার্জনসহ জেলার প্রধান প্রধান সরকারি অফিসের কর্মকর্তারা। প্রতিটি জেলায় জেলা ও দায়রা জজ এই কমিটির চেয়ারম্যান। বিচারিক কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সহকারী জজ লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম চালান।

২০০০ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান আইন। একই বছর জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংস্থাই সারা দেশের কাজ তদারক করে।

লিগ্যাল এইড অফিসে যাঁরা সেবা নিতে আসেন, তাঁদের আইনি পরামর্শ ও সেবা দেওয়া হয়। আইনি প্রক্রিয়া বা মামলায় যাওয়ার আগেই লিগ্যাল এইড কমিটি বিরোধ নিষ্পত্তি চেষ্টা করে। সব রকম চেষ্টার পরও যদি বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া, অর্থাৎ মামলা করার সব প্রক্রিয়া সহায়তা করে লিগ্যাল এইড অফিস। মামলায় আইনজীবী নিয়োগ থেকে শুরু করে সব খরচই দেয় সরকার।

সালমা ও সমাপ্তির গল্প
মাত্র ১০ মাসে মাগুরায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমে ২৯টি ভেঙে যাওয়া সংসার নতুন করে জোড়া লেগেছে। ২০১৬ সালে লিগ্যাল এইড অফিসে আইনগত সহায়তার জন্য আবেদন পড়েছিল ২০১টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬৪টি। ২০১৭ সালে আবেদন জমা পড়ে আগের বছরের দ্বিগুণের বেশি, ৪৪৮টি। নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে ২১৮টি। এ ছাড়া চলতি বছরের গত মার্চ মাস পর্যন্ত আবেদন পড়েছে ১৬৩টি এবং আবেদনের নিষ্পত্তি হয়েছেও ৪৯টি।

মাগুরার সালমাকে যমজ শিশুসন্তানসহ বাড়ি থেকে বের করে দেন তাঁর স্বামী রফিক। অকূলপাথারে পড়ে মাগুরা লিগ্যাল এইড অফিসের শরণাপন্ন হন তিনি।

লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা ইয়াসমিন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা করে স্বামী-সংসারের অধিকার ফিরে পাওয়া খুবই মুশকিল। তার ওপর মামলার প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ। সালমা লিগ্যাল এইড অফিসে আসার পর আমরা তাঁর স্বামীকে নোটিশ করি। ডেকে পাঠাই। দুবার বসি। আলাপ-আলোচনা করি। আইনগত ঝামেলার বিষয়টি তাঁকে বোঝাই। মানবিক নানা বিষয়ে কথা বলি। একসময় তিনি বুঝতে পারেন। আবেগে সবার সামনেই শিশু দুটিকে বুকে টেনে নেন। এভাবে সালমার ভেঙে যাওয়া সংসার আবার জোড়া লাগে।’

যোগাযোগ করা হলে আবেগাপ্লুত সালমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘লিগ্যাল এইড অফিস না থাকলে আমি বাচ্চা দুটো নিয়ে পথে পথে ভেসে বেড়াতাম।’

সমাপ্তি নামের আরেক নারীর ক্ষেত্রে অনেক চেষ্টার পরও সংসার জোড়া লাগেনি বটে, তবে স্বামী হাসানের কাছ থেকে আপসে দেনমোহর ও খোরপোশের টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে।

লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা জানালেন, যাঁরা আইনি সহায়তা চাইতে আসেন, দু-চারটি বাদে তাঁদের সবাই আসেন দাম্পত্য বিরোধ ও নারীর প্রতি সহিংসার ঘটনা নিয়ে। আপস-মীমাংসার মাধ্যমে যাঁদের বিরোধ নিষ্পত্তি হচ্ছে না, তাঁদের জন্য লিগ্যাল এইড অফিস থেকে বিনা খরচে আইনজীবী নিয়োগ করে দেওয়া হয়। ‘বিচার গরিবের জন্য নয়’—এ ধারণা পাল্টে দিতেই লিগ্যাল এইড ধারণার সৃষ্টি।

এই সেবার খবর মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দিতে উপজেলা, ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত জেলা ও দায়রা জজসহ অন্যরা ছুটে যাচ্ছেন। সভা-সমাবেশ করছেন।

জানতে চাইলে মাগুরার জেলা আইনগত সহায়তা প্রদান কমিটির চেয়ারম্যান জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার যে গরিব মানুষের মামলার খরচ দেয়, এ সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুব কম। মামলার আগেই যদি বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়, তাহলে মামলা জট কমবে।

ঢাকা জেলার চিত্র
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইনগত সহায়তা সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন এসেছে ঢাকায়।

২০১৫ সালে আইনগত সহায়তা সেবা নিয়েছিলেন ২ হাজার ২৩ জন। ২০১৬ সালে সেটা বেড়ে হয় ৩ হাজার ২৪০ জন। আর ২০১৭ সালে ৪ হাজার ২৭০ জনকে আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৫টি।

উত্তরার বাসিন্দা খালেদা আকতার তাঁর পারিবারিক সমস্যার কথা জানিয়ে লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে আবেদন করেন ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা রাজেশ চৌধুরী তাঁর সব কথা শুনে অভিযোগ আমলে নিয়ে খালেদা আকতারের স্বামী মাসুম চৌধুরীকে নোটিশ করেন। নোটিশ পেয়ে মাসুম চৌধুরী জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে হাজির হন। লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় আলোচনার পর পারিবারিক বিরোধ মেটানো হয়।

সারা দেশের চিত্র
২০০৯ সালে জেলা লিগ্যাল এইড কিমিটি গঠনের পর থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ২ লাখ ১ হাজার ১২৫ জনকে আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে আইনি পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বিধিমালা হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে আইনি সুবিধা পেয়েছেন ৬ হাজার ৯১৫ জন। মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির জন্য গত বছর দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছে। ফলে আদালতগুলো এখন উপযুক্ত মামলাগুলো লিগ্যাল এইড অফিসে পাঠিয়ে দিতে পারেন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য।