নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পর গাজীপুর এখন বিষাদের শহর

• ব্যস্ততার মধ্যে হঠাৎ থমকে গেছেন প্রার্থীরা। 
• বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি নিয়েও প্রার্থীরা চিন্তিত। 
• হতাশায় নিমজ্জিত মানুষের জিজ্ঞাসা, কেন এমন হলো!
• উৎসব ফিরে পেতে চায় সবাই।

আকস্মিক ঝড়ে যেন নিস্তব্ধ চারপাশ। এ ঝড়ে ক্লান্তিহীন ব্যস্ততার মধ্যে হঠাৎ থমকে গেছেন প্রার্থীরা। বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি নিয়েও চিন্তিত তাঁরা। শহরের সর্বত্র নীরবতা নেমে এসেছে। বিভিন্ন মোড়ে চায়ের দোকানগুলোতে ঝিম মেরে বসে আছেন কিছু মানুষ। এক দিন আগেও সরব মানুষগুলো এখন ভাষাহীন। চোখেমুখে চাপা পড়ে আছে ক্ষোভ। কারও মুখে হাসি নেই। হতাশায় নিমজ্জিত মানুষগুলোর জিজ্ঞাসা, কেন এমন হলো! আদালতের আদেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পর এখন বিষাদের শহর গাজীপুর।

গতকাল সোমবার সকালে গিয়ে বদলে যাওয়া গাজীপুরের চিত্র চোখে পড়ে। মাইকে প্রচারের আওয়াজ নেই, কর্মী বা প্রার্থীদের জনসংযোগ নেই। রাস্তায় রাস্তায় দল বেঁধে মানুষের ছোটাছুটি নেই কোথাও। টঙ্গী পৌরসভার পাশে অবস্থিত বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের বাসার সামনে কোনো জটলা নেই। এক দিন আগের সরগরম বাসাটি সুনসান হয়ে আছে। ভিড় নেই, কয়েকজন বসে আছেন তাঁর অফিস কক্ষে। নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাওয়ার হতাশা ও হামলা-মামলার আশঙ্কার কথা জানালেন তাঁরা।

হাসান উদ্দিন সরকার এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিশ্চিত পরাজয় জেনেই সরকারি দল আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। আদালতের আদেশ নিয়ে তো আমাদের কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের সবার মন ভেঙে গেছে। প্রার্থীরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সংক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে গিয়েছি। আদালত নিশ্চয়ই পুনর্বিবেচনা করবেন। আমরা এখনো নির্বাচনের ব্যাপারে আশাবাদী।’

বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। কথা হয় হাজি আবদুর রশীদ (৭০), মোহাম্মদ ইমান আলী (৪৯), মো. সিরাজ (৫০), মো. কবির হোসেনের (২৮) সঙ্গে। বিভিন্ন বয়সী গাজীপুরের এ ভোটাররা প্রায় একই সুরে হতাশার কথা বলেন। তাঁরা বলেন, ‘সবকিছু ঠিক করেই নির্বাচন কমিশন তফসিল দিয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা ভোট দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি। গাজীপুরের কোথাও কোনো মারামারি-হানাহানি হয়নি। প্রার্থীদের মধ্যে বিরোধ হয়নি। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকার পরও কেন ভোট স্থগিত করে দেওয়া হলো। আদালতের রায় নিয়ে কারও কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু আদালত কেন আগে ব্যবস্থা নিলেন না। আমাদের কী অপরাধ! আমরা ভোট দিতে চাই। আদালত আমাদের ভোটের ব্যবস্থা করুন।’

আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের জমজমাট বাড়িটিও অনেকটা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। তিনি গেছেন সাবেক সাংসদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য সেখানে গিয়েও পাওয়া যায়নি। ততক্ষণে তিনি ঢাকায় চলে গেছেন। মৃত্যুবার্ষিকীর ওই অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সমাগমে আলোচনার বিষয় ছিল কেন নির্বাচন স্থগিত, এতে কার লাভ, কার ক্ষতি ইত্যাদি।

তবে এ সময় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানের সমর্থকেরা ছিলেন খোশমেজাজে। তিনিও প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। স্থানীয় রাজনীতিতে রেষারেষি থাকলেও আজমত উল্লা ছিলেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন ঘিরে জনগণের মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আদালতের রায়কে সম্মান জানাতেই হবে। এখন আইনি জটিলতার অবসান করে অতিসত্বর একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাই আমরা।’

গাজীপুর সিটি করপোরেশন
গাজীপুর সিটি করপোরেশন

স্থানীয় নির্বাচন কমিশন অফিসে গিয়ে দেখা যায়, কোনো ব্যস্ততা নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চুপচাপ বসে আছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, ‘সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ১০০ মাইল গতিতে দৌড়াচ্ছিলাম, হঠাৎ থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আকস্মিক ধাক্কায় এখন সবাই ক্লান্ত।’ রিটার্নিং কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব রকিব উদ্দিন মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের আদেশে নির্বাচনী কার্যক্রম স্থগিত করতে বলেছে নির্বাচন কমিশন। আমরা তা-ই করেছি। এখন কমিশনের পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায় আছি।’

৫৭টি ওয়ার্ডে ২৫৪ জন কাউন্সিলর, ৮৪ জন মহিলা কাউন্সিলর, ৭ জন মেয়র প্রার্থী মিলে সিটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। তাঁরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। সাবেক প্যানেল মেয়র ও এবারের কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল করিম বলেন, সব দলের প্রার্থীরা ভোটারদের দুয়ারে গেছেন। একটা উৎসবের আমেজ ছিল। এখন মানুষের মুখে হাসি নেই, সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। এত খাটুনির পর বন্ধ হয়ে যাওয়া কেউ মেনে নিতে পারছে না। তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানান। তাঁর মতোই প্রতিক্রিয়া জানান আরেক সাবেক প্যানেল মেয়র ও ৪০,৪১, ৪২ ওয়ার্ডের (সংরক্ষিত ১৪) কাউন্সিলর প্রার্থী, মহানগর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক হোসনে আরা সিদ্দিকি। তিনি বলেন, জটিলতা যদি থেকেই থাকে, তফসিল কেন হলো? মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগেও তো বন্ধ করা যেত। লাখ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। বাজেটের ১২ আনা ব্যয় হয়ে গেছে। তীরে এসে কেন নাও ডুবিয়ে দেওয়া হলো।

উৎসব ফিরে পেতে চায় সবাই। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুর জেলা সভাপতি মুকুল কুমার মল্লিক বলেন, নির্বাচন নিয়ে একটা উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। ভোটাররা অপেক্ষমাণ ছিলেন। নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়াতে উৎসবে ভাটা পড়েছে। কোনো ধরনের সহিংসতা না হওয়ায় গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা ছিল বলেও মনে করেন তিনি।