মিয়ানমারের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জোর দেবে বাংলাদেশ

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। রয়টার্স ফাইল ছবি
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। রয়টার্স ফাইল ছবি


রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানো শুরুর জন্য ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারকে আট হাজারের বেশি লোকের তালিকা দেওয়ার পর দেশটি তিন মাস ধরে সাত ধাপে যাচাই-বাছাই করে মাত্র ৮৭৮ জনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে।

সীমান্তের ওপারে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর পরিবেশ হয়েছে কি না, সেটাই নিশ্চিত নয়। এমন এক পরিস্থিতিতে আগামী বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) বৈঠকে প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টিতে জোর থাকবে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশের এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন চুক্তি সইয়ের প্রায় ছয় মাসের মাথায় এখনো এ নিয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। তাই বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন শুরুর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেবে। আবার রাখাইনের আগস্ট–পরবর্তী নৃশংসতার অভিযোগে সেখানকার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহির বিষয়টি এখন যথেষ্ট আলোচিত হচ্ছে। ধারণা করা যায়, মিয়ানমার তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযুক্ত লোকজনকে জবাবদিহিতে আনার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে চলার বিষয়টি সামনে আনবে।

ঢাকা ও নিউইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধের আদালত এক প্রাক্‌–শুনানিতে রোহিঙ্গা নির্যাতনের তদন্তের কথা তুলেছে। আগামীকাল সোমবার নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির বিষয়ে আবার আলোচনা হতে যাচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্তের বিষয়টি জোরালো হচ্ছে।

ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জেডব্লিউজির দ্বিতীয় বৈঠকে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক বাংলাদেশের আর মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব মিন্ট থোয়ে তাঁর দেশের নেতৃত্ব দেবেন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য গত বছরের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি সই করেছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর থেকে পরের কয়েক মাস এবং গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর ৮৭ হাজার এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে ৬ লাখ ৯২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। সংখ্যায় কম হলে এখনো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে।

২৩ নভেম্বর সই হওয়া চুক্তির ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবাসনের বিষয়টি তত্ত্বাবধানের জন্য পরের মাসে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের নেতৃত্বে জেডব্লিউজি গঠন করা হয়। এ বছরের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের নেপিডোতে জেডব্লিউজির প্রথম বৈঠক হয়। আর প্রত্যাবাসনের কাজে সহায়তার জন্য জানুয়ারি এবং এপ্রিলে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সঙ্গে দুটি আলাদা সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ।

গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকের সময় প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের কাছে ৮ হাজার ৩২ জনের তালিকা পাঠায় বাংলাদেশ। এর মধ্যে সাত দফায় ওই তালিকায় ১ হাজার ৩৯ জন রোহিঙ্গার মধ্যে ৮৭৮ জনের পরিচয় নিশ্চিত করে বাংলাদেশের কাছে পাঠিয়েছে মিয়ানমার। প্রায় তিন মাস ধরে মাত্র ৮৭৮ জনের পরিচয় নিশ্চিত করলেও তালিকা নিয়ে বাংলাদেশের ওপর দায় চাপাতে চাইছে মিয়ানমার।

শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের কাছে তালিকা পাঠানোর পাশাপাশি প্রত্যাবাসন কেন্দ্রসহ অন্যান্য কাজও বাংলাদেশ করছে। এর মধ্যে নৌপথে প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফের কেরনতলীতে একটি কেন্দ্র নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া স্থলপথে প্রত্যাবাসনের জন্য বান্দরবানের গুমদুমে জমি অধিগ্রহণসহ প্রস্তুতি মূলক কাজ শুরু হয়েছে।

জেডব্লিউজির বৈঠকের প্রতিপাদ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক গতকাল সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রত্যাবাসনের জন্য যেসব কাজ করা দরকার, বাংলাদেশ চুক্তি সইয়ের পর থেকেই সেগুলো শুরু করেছে। ইউএনএইচসিআরকে যুক্ত করেছে, মিয়ানমারকে তালিকা দিয়েছে। আবার বর্ষাকে সামনে রেখে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিচ্ছে। প্রত্যাবাসনের জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিচ্ছে। এখন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সহায়ক পরিবেশ ফিরিয়ে, প্রত্যাবাসন টেকসই করার দায়িত্ব মিয়ানমারের। তাই মিয়ানমারকে তাদের দায়িত্ব পালন করে প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য বলব।’

গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের যে ঢল শুরু হয়েছে, তার সাড়ে আট মাস পরও মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজনের বাংলাদেশে আসা থামেনি। আবার প্রত্যাবাসন শুরুতেও তেমন অগ্রগতি নেই। এ নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক এই প্রতিবেদককে বলেন, শুধু বাংলাদেশ কেন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া—এসব দেশ থেকেও মিয়ানমার সে দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিচ্ছে না। কাজেই বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা নানা ছুতো দেবে। এরপরও প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে দায়িত্বগুলো রয়েছে, সেগুলো করার পাশাপাশি মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।