সীতাকুণ্ডে ওজন স্কেল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ

সীতাকুণ্ডের দারোগাহাট এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশনের (ওজন স্কেল) ভাঙচুরের দৃশ্য। দারোগাহাট, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম, ১৯ মে। ছবি: কৃষ্ণ চন্দ্র দাস
সীতাকুণ্ডের দারোগাহাট এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশনের (ওজন স্কেল) ভাঙচুরের দৃশ্য। দারোগাহাট, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম, ১৯ মে। ছবি: কৃষ্ণ চন্দ্র দাস


পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের অভিযোগ, ওজন স্কেলে স্থানীয় মাস্তান চক্র বিভিন্ন সময়ে চাঁদা আদায় করে। অকারণ জরিমানা নেন ওজন স্কেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। সরকারি তদন্তেই দেখা গেছে, বিকাশের মাধ্যমে টাকা নিয়ে অতিরিক্ত ওজনের গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।

দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার না করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর নির্মিত ওজন স্কেলটির পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ বলছে, দুর্নীতি আছে। তবে পরিবহনশ্রমিকেরাও চান না এ স্কেল থাকুক।

এমন অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ সীতাকুণ্ডের বড়দারোগাহাট এলাকায় নির্মিত ওজন স্কেল নিয়ে। গত শনিবার সকালে উভয় দিকের টোল কার্যালয় ও পুরো সিস্টেম ভাঙচুর করে ক্ষতিগ্রস্ত করে একদল ব্যক্তি। ফলে অনির্দিষ্টকালের জন্য সিস্টেমটি বন্ধ হয়ে যায়।

শনিবারের ঘটনা নিয়ে সীতাকুণ্ডের এই স্টেশন গত দুই বছরের মধ্যে দুই দফা হামলার শিকার হলো। ২০১৬ সালের ২৩ আগস্ট রাতে স্কেলটির পশ্চিমপাশের টোল বক্স অফিস, কম্পিউটারসহ পুরো সিস্টেম পুড়িয়ে দেন পরিবহনশ্রমিকেরা। সর্বশেষ হামলায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কর্মকর্তারা।

শনিবারের ভাঙচুরের ঘটনায় সীতাকুণ্ড থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সওজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রবিউল হোসেন বাদী হয়ে শনিবার রাতে মামলাটি দায়ের করেন। এতে অজ্ঞাত ২০০ জন পরিবহনশ্রমিককে আসামি করা হয়।

ওজন স্কেলের সিগন্যালের দায়িত্বে থাকা লোকজন শনিবার সকালে এক ট্রাকচালক ও তাঁর সহকারীকে মারধরের পর মৃত্যুর গুজবে পরিবহনশ্রমিকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওজন স্কেল ভাঙচুর করেন। এ সময় তাঁরা চারটি কম্পিউটার, সার্ভার, ক্যামেরাসহ পুরো সিস্টেম ভাঙচুর করে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। লেগে যায় দীর্ঘ যানজট। এ কারণে বন্ধ হয়ে ওজন স্কেলের কার্যক্রম।

ওই সহিংসতার ভয়াবহতা প্রসঙ্গে সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে জানান, ঘটনা খবর শুনে তিনি দ্রুত ঘটনাস্থলে যান এবং পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে থামানোর চেষ্টা করেন। গতকালের হামলা পরিবহনশ্রমিকদের কোনো একক গ্রুপের নেতৃত্বে পরিচালিত না হওয়ায় একটি গ্রুপকে নিবৃত্ত করা গেলেও অন্য গ্রুপকে তিনি থামাতে পারছিলেন না। ফলে বল প্রয়োগে বাধ্য হন।

কামরুজ্জামান বলেন, তাঁর কাছে মনে হয়েছে, চালক ও সিগন্যালম্যান, দুজনেরই দোষ রয়েছে। সেখানে একটি স্থানীয় চক্র জড়িত। এসব দিক বিবেচনা করে তিনি জেলা প্রশাসককে চিঠি দেবেন বলে জানান।

সীতাকুণ্ড থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ওজন স্কেল ভাঙচুরের ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

সওজ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পুরো সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কখন চালু করা হবে, তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে সিস্টেমটি আবারও চালু করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

ওজন স্কেলে কেন বারবার হামলা
হামলার কারণ নিয়ে সওজ, ওজন স্কেল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান র‌্যাগনাম রিসোর্স লিমিটেড, গাড়ির চালক, মালিক সমিতি পরস্পরবিরোধী দাবি করছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, স্কেলবিরোধীদের ইন্ধনেই হামলা হচ্ছে। অন্যদের মতে, চাঁদাবাজিই হচ্ছে সমস্যার মূল কারণ।

পরিবহনশ্রমিক-মালিকপক্ষ বলছে, ওজন স্কেলে লোকজন বিভিন্ন সময়ে চাঁদা ও জরিমানা আদায় করছেন। না দিতে চাইলে পরিবহনশ্রমিকদের মারধর ও গাড়ি ভাঙচুর করেন। আবার কোনো কোনো ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি ওজন স্কেলের দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে চুক্তি করে স্কেলে না ঢুকিয়ে চলে যাচ্ছে পরিমাপ ছাড়া। অনেক সময় গতির কারণেও মূল ওজনের তুলনায় বেশি ওজন দেখায়। অনুমোদিত পরিমাপের কিছু পরিমাণ বাড়তি হলে তা বিবেচনায় না নিয়ে বরং অতিরিক্ত ওজনের যা জরিমানা, তা আদায়ের চেষ্টা করে। জরিমানা মাপের জন্য ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা বেশি দাবি করে। অনুমোদিত ওজনের চেয়ে কম ওজনের গাড়ির চালকদের থেকে বিভিন্ন অজুহাতে টাকা দাবি করেন স্কেলের লোকজন।

ট্রাকচালক হুমায়ুন কবিরের বললেন, তিনি অনুমোদিত ওজনের চেয়ে কম ওজন নিয়ে যাচ্ছিলেন। অথচ তাঁর কাছে ৫০০ টাকা চাঁদা দাবি করে বলা হয়, নয়তো স্কেলের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। টাকা দিতে না চাইলে তাঁকে মারধর করা হয়।

কাভার্ড ভ্যানের চালক আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, অনুমোদিত ওজনের থেকে ৫০ কেজি ওজন বেশি পাওয়ায় তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা চেয়ে বসে। অথচ ২০ টন ওজনের ক্ষেত্রে ৫০ কেজি কিছুই না। তাতেও জরিমানা দিতে হয়।

মালামাল পরিবহন ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দ্বীন মোহাম্মদ প্রথম আলোকে শনিবার বলেন, ওজন স্কেলে কিছু দুর্নীতিবাজ লোক রয়েছেন। তাঁরা কতগুলো ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির অতিরিক্ত ওজনের গাড়িকে অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেন। আবার অনেক গাড়িকে অনুমোদিত ওজনের একটু বেশি ওজন নিলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা নেন।

বিকাশের মাধ্যমে টাকা নিয়ে অতিরিক্ত ওজনের গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার প্রমাণও পেয়েছে সীতাকুণ্ড উপজেলা প্রশাসন। গত ৬ এপ্রিল সীতাকুণ্ডের তখনকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন।

সওজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রবিউল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহন-সংশ্লিষ্ট একটি পক্ষ চায় ওজন স্কেল না থাকুক। ওই পক্ষের ইন্ধনে হামলাগুলো হচ্ছে। সওজের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক স্কেল এলাকায় থাকেন। তা ছাড়া তাঁর ও নির্বাহী প্রকৌশলীর ফোন নম্বর সেখানে দেওয়া আছে অভিযোগ জানানোর জন্য। তাঁদের কোনো অভিযোগ থাকলে জানাতে পারতেন। কেউ জানান না। কয়েকজন চালক স্কেল এলাকা ত্যাগ করার পর অভিযোগ করেন। সেটি তদন্ত করতে চালকেরা আর স্কেল এলাকায় যেতে চান না। স্কেলের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে বলেন, স্কেল লাইনে ঢুকতে বাধ্য করায় এ অভিযোগ করেছে।

ওজন স্কেলটির পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন জনি প্রথম আলোকে বলেন, সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা লোকজন কোনো গাড়িকে ওজন স্কেল লাইনে যাওয়ার সংকেত দিলে অনেক চালক সংকেত অমান্য করে স্কেল লাইনের বাইরের লাইন (মূল সড়ক) দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সে ক্ষেত্রে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। এ ছাড়া অনিয়মের ব্যাপারে যখন কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা পেয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে তিনি জানান। গত দুই বছরে তাঁরা ১০ জনকে স্কেলের কার্যক্রম থেকে প্রত্যাহার করেছেন।

সওজের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রবিউল হোসেন বলেন, আর্থিক সুবিধা নিয়ে অতিরিক্ত ওজনের গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়।