কর্মজীবী নারী বেড়েছে, পরিবহনে সুবিধা বাড়েনি
সার্ক ফোয়ারা মোড়ে শাহীনা বেগমকে (৪০) বাসের জন্য প্রতিদিন ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করতে হয়। তাঁর বাসা মিরপুর। এই রুটে মিরপুরের বাস থাকলেও এক পা এগিয়েই দুই পা পেছান। শাহীনা বলেন, ‘অফিস ছুটির সময়টা কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার মোড়কে আমার যুদ্ধক্ষেত্র মনে হয়। আর ভিড়ের মধ্যে গায়ে হাত দেওয়ার মতো জঘন্য ঘটনা তো ঘটেই চলেছে।’
গত ২০ মার্চ বিকেলে অফিস ছুটির সময়ে সার্ক ফোয়ারা মোড়ে প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে শাহীনাসহ কয়েকজন নারীকে বাসে ওঠার জন্য কসরত করতে দেখা যায়। একটি বাস এলেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। নারীদের কেউ কেউ ওই ভিড়ের মধ্যেই ঠেলাঠেলি করেই ওঠেন। আবার অনেকেই ভিড় কমার অপেক্ষায় থাকেন। বাসগুলোও ঠিকমতো থামে না। যাত্রীতে ঠাসা থাকলে চলন্ত অবস্থাতেই লোক তোলা হয়। শাহীনা সেদিন ৪০ মিনিট অপেক্ষা করে মিরপুরের একটি বাসে উঠতে সক্ষম হন। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলেও এই মোড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েই বাসে উঠতে হয়। কোনো বাস বে (যাত্রী ওঠা-নামার জায়গা) বা স্টপেজ নেই।
রাজধানীতে গণপরিবহনে চলতে গিয়ে নারীরা মানসিক ও শারীরিক পীড়নে ভুগছেন। পরিবহন সমস্যার কারণে বেশি দূরত্বের চাকরি ও পছন্দের চাকরি করতে পারছেন না অনেকে। আবার ঝামেলা এড়াতে বাস বাদে অন্য পরিবহন ব্যবহারে আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে। দেরি হলে পরিবার ও অফিসে কটূক্তিও শুনতে হয়। এর সঙ্গে যৌন হয়রানি তো আছেই।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, রাজধানীতে বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন সাত হাজার বাস চলে। এর মধ্যে সরকারি পরিবহন বিআরটিসির বাস ৪০০টি।
বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া গণপরিবহনে নারীদের সমস্যা নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বাস্তবতাটা ফিল করি। দুর্ভাগ্যবশত আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও গাড়ির অভাবে আমরা সেই সেবাটা দিতে পারছি না।’
চাকরির সুযোগ হারাচ্ছেন নারীরা
পরিবহন সমস্যায় পড়ে চাকরি ছাড়ার এবং চাকরির সুযোগ হারানোর ঘটনাও ঘটছে। তাহেরা মাহমুদ বনানীর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। দেড় বছর চাকরি করার পর চাকরি ছেড়ে দেন। তাঁর বাসা রামপুরার হাজীপাড়ায়। দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। স্কুলে যাওয়ার সময় চারবার এবং ফেরার পথে তিনবার যানবাহন পরিবর্তন করতে হতো। কোনো সরাসরি যানবাহন ছিল না। প্রতিদিনই দেরি হতো। যাতায়াতে ব্যয় হতো চার ঘণ্টা। বেতনের এক-তৃতীয়াংশ চলে যেত ভাড়ায়।
দূরত্ব ও যানবাহন সমস্যার কারণে তাহেরা এখনো পছন্দের কোনো স্কুলে চাকরি নিতে পারছেন না। কিন্তু চাকরিটাও তাঁর দরকার।
সাদিয়া আফরিনের বাসা ডেমরায়। বাসা ও অফিসের মধ্যে দূরত্ব বেশি হওয়ায় অনেক জায়গায় চাকরি হয়নি। সাদিয়া বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠানে আমার সিভি দেখার পর বলা হয়, এই মেয়ে তো ডেমরায় থাকে, এসে অফিস করতে পারবে না।’
ভয়ংকর হয়ে উঠছে বাসের অভিজ্ঞতা
সম্প্রতি বাসে যৌন হয়রানির বেশ কতগুলো ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। গত মার্চ মাসে নিউ ভিশন বাসের এক চালক ও সহকারীকে ধরা হয় যৌন হয়রানির অভিযোগে। উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে গত ২৯ এপ্রিল হয়রানির অভিযোগে তুরাগ পরিবহনের এক চালক ও দুই সহকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এ ছাড়া ফেসবুকে প্রায় নিয়মিতই কোনো না কোনো নারী গণপরিবহনে নিপীড়নের কথা তুলে ধরছেন। ২০১৭ সালের আগস্টে রূপা খাতুনকে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক গত মার্চ মাসের এক জরিপে জানিয়েছে, গণপরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের ৯৪ শতাংশই যৌন হয়রানির শিকার।
নিপীড়ন, অনিরাপত্তার সঙ্গে আছে বাজে পরিবেশ। বাস বে ও স্টপেজের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় রাজধানীর পুরো সড়কই স্টপেজ। আবার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা থাকলেও সেটা ব্যবহারের অনুপযোগী। ছাউনিগুলো হকার ও ভবঘুরেদের দখলে। বাসের পরিবেশ নিয়েও নারীরা সন্তুষ্ট নন। সম্প্রতি কয়েকটি স্থানে সিটি করপোরেশন পাবলিক টয়লেট চালু করলেও সব বাসস্ট্যান্ডে সে সুবিধা নেই।
মানসিক পীড়ন
পল্লবীর মারিয়া ইসলামের (২৬) অফিস গুলশানে। তিনি বলেন, ‘যানজট ও ট্রান্সপোর্টের কারণে আমাদের যে কত ক্ষতি হচ্ছে! অনেকেই অফিসের কাছাকাছি বাসা নিয়ে নেয়। এখানে তো আমার নিজের বাসা, আমি তো পাল্টাতে পারব না। কিন্তু আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ি। হ্যারাসমেন্ট তো আছেই। মেজাজও খারাপ করি বাসার লোকের সাথে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ্ দীবা নারীদের এ সমস্যার ব্যাপারে বলেন, যাতায়াতে মেয়েদের চরম ধরনের হতাশা তৈরি হয়। এক চাপের সঙ্গে আরও চাপ যুক্ত হয়ে বড় ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে। বিষণ্নতা থেকে ধীরে ধীরে শারীরিক ক্ষতি হয়। দীর্ঘমেয়াদি কর্মক্ষমতা কমতে থাকে।
আর্থিক ক্ষতি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, একজন ছেলের চেয়ে একজন মেয়ের যাতায়াত খরচ বেশি। সময়মতো বাসায় পৌঁছানোর তাড়া থেকে মানসিক চাপে থাকেন নারীরা।
হুড়োহুড়ি করে বাসে ওঠা এবং দ্রুত বাড়ি ফেরার তাড়নায় নারীরা অনেকেই বাসের পরিবর্তে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা উবার-পাঠাওয়ের মতো অ্যাপসভিত্তিক যান ব্যবহার করেন। এসব যানের ভাড়া বাসের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
জাহিদা হকের বাসা মোহাম্মদপুরে। গুলশান যেতে তাঁর বাসভাড়া ২০ টাকা। অর্থাৎ বাসে যাতায়াতে মাসে তাঁর খরচ ৮০০ টাকা। কিন্তু সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া ২৫০ টাকা। এতে তাঁর যাতায়াতে মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। তিনি বলেন, ‘ছয়টার পর অফিস থেকে বের হলে বাসে উঠতে পারি না। সকালে হুড়োহুড়ি করে বাসেও ওঠা সম্ভব নয়।’
কর্মজীবী নারী বাড়লেও নারীবান্ধব সুবিধা বাড়েনি
কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে মজুরির বিনিময়ে কাজ করা নারীর সংখ্যা ১ কোটি ৮৬ লাখ।
আগের চেয়ে গণপরিবহনে নারীদের ভোগান্তির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। সাবেক জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা রোকসানা বেগম ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত গাজীপুরে কর্মরত ছিলেন। প্রতিদিন মহাখালী থেকে গিয়ে অফিস করতেন। চাকরির বয়স থাকার পরেও ২০০৪ সালে পরিবহন সমস্যার কারণে অবসর নিতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, ‘ওই সময়কার কথা মনে হলেই আঁতকে উঠি। বাসগুলো ছিল লক্করঝক্কর। বাসের পরিবেশ অসহনীয়। ওঠা-নামার সময়ে গায়ে হাত দিয়ে তুলত। ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিত।’
তবে ১৪ বছর পরে এসেও নারীদের হয়রানির সেই চিত্র পাল্টায়নি। বেসরকারি একটি সংস্থার কর্মকর্তা সাবরিনা রহমান (৫৬) প্রতিদিন আদাবর থেকে গুলশানে গিয়ে অফিস করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো কোনো বাস স্টপেজ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে দাঁড়িয়ে থাকি, পাবলিক টয়লেট তো দূরে থাক, একটু বসারও সুযোগ নেই। আমার প্রথম বাচ্চা হওয়ার সময় খুব কষ্ট হয়েছিল। একজন গর্ভবতী নারীর জন্য এ দেশের গণপরিবহন যে কতটা ভয়ংকর তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।’
বাস আছে, বাস নেই
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী রাজধানীতে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা ২৮ হাজার ২২২। কিন্তু নারীদের জন্য বাস আছে মাত্র ১৫টি। সেটাও সরকারি পরিবহন সেবা বিআরটিসির। বাসগুলো তালতলা, রামপুরা, নতুনবাজার, জোয়ারসাহারা, কল্যাণপুর, মিরপুর–১০, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মোহাম্মদপুর, উথলীসহ ১০টি স্থান থেকে ছাড়ে। এদের গন্তব্য শুধু মতিঝিল।
এ প্রতিবেদন করতে গিয়ে ১১ জন কর্মজীবী নারীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের সবারই কথা, মহিলা বাস সার্ভিস পর্যাপ্ত নয়। সকাল ও সন্ধ্যা বাদে বাকি সময়ে বাসগুলো চলে না।
খিলগাঁওয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আফসানা খানম (৩৮) বলেন, ‘মতিঝিল ছাড়াও তো অফিস অন্য এলাকায় আছে। আর এ বাসগুলো অফিস টাইমেই চলে। বাকি সময় বসে থাকে। কিন্তু নারীদের তো সব সময় চলতে হচ্ছে। নারী শিক্ষার্থী, কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনে চলাচলকারী ছাড়াও নারীদের সব ময়ই ঢাকায় চলতে হয়। এই বাসগুলো বাকি সময়েও চলা উচিত।’
তবে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ বলছে ভিন্ন কথা। তাঁরা জানান, অফিস বাদে অন্য সময় নারী যাত্রী পাওয়া যায় না। নারায়ণগঞ্জ ও মতিঝিল ডিপোর বাসগুলো দিনে সাধারণ পরিবহন হিসেবে চলাচল করে। নারায়ণগঞ্জ ডিপোর ম্যানেজার মোশারফ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, নারীদের বহনকারী বাসগুলোয় যেহেতু মেয়েদের ছবি দিয়ে স্টিকার লাগানো থাকে, তাই অফিস সময় বাদে আলগা ভিন্ন রকমের একটি স্টিকার লাগিয়ে মতিঝিল থেকে টঙ্গী রুটে চলে। আর নারীদের বাসে যেহেতু পুরুষদের ওঠার সুযোগ নেই, তাই কোনো নারীর সঙ্গে পুরুষ কেউ থাকলে তাঁরা উঠতে চান না।
বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া জানান, আগামী ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে বিআরটিসি ৪০০ বাস নামাবে। তখন রুট ও প্রয়োজন বিবেচনা করে নারীদের জন্য বাসের সংখ্যা বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, সরকারি পরিবহনের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের পরিবহনকেও এগিয়ে আসাতে হবে। অসংখ্য মালিক না রেখে চার-পাঁচটি কোম্পানির অধীনে একেক রুটের একেক রঙের বাস নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিটি কোম্পানির অন্তত ১০ শতাংশ বাস মেয়েদের জন্য বরাদ্দ থাকা দরকার। এ ছাড়া বাসের কর্মচারীদের কাউন্সেলিং করাতে হবে মেয়েদের ও যাত্রীদের সঙ্গে ব্যবহারের বিষয়ে। নিয়মনীতি প্রয়োগের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।