দুই হাজার নলকূপ অচল, পানির সংকটে রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি আশ্রয়শিবিরে খাবার পানির সংকট চলছে। প্রাকৃতিক জলাশয়, খাল ও পুকুরের ময়লাপানি খেয়ে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে রোহিঙ্গারা।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাত হাজার নলকূপের মধ্যে ইতিমধ্যে দুই হাজার অচল হয়ে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাওয়ায় এর কারণ। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে আরও কয়েক শ নলকূপ।

কক্সবাজার শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার মধুরছড়া ১ ও ২ নম্বর আশ্রয়শিবির। এই শিবিরের কয়েকটি পাহাড়ের ঢালুতে ত্রিপলের ঘরে বাস করছে দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা। পাশের লম্বাশিয়া ১ ও ২ নম্বর শিবিরে আছে আরও এক লাখ রোহিঙ্গা। এই আড়াই লাখ রোহিঙ্গার পানির চাহিদা পূরণে শিবিরগুলোতে স্থাপন করা হয়েছিল এক হাজারের বেশি নলকূপ।

গত বুধবার ওই শিবিরগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, অসংখ্য নলকূপ অকেজো। কিছু নলকূপের ওপরের অংশ চুরি হয়ে গেছে। নারী-শিশুদের দূরের জলাশয়, পুকুর ও খাল থেকে কলসিতে করে পানি আনতে দেখা গেছে।

লম্বাশিয়া-১ আশ্রয়শিবিরের বি ব্লকের মাঝি (সর্দার) আবুল হোসেন বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাহাড়ের ঢালুতে ২০-৩৫ ফুট গভীরতায় কয়েক শ নলকূপ স্থাপন করে। এ বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি কক্সবাজার, ব্রাক, শেডসহ কয়েকটি সংস্থা শিবিরে কয়েক শ গভীর নলকূপ স্থাপন করে। এসব নলকূপের বেশির ভাগ চালু রয়েছে।

মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরের ডবল জিরো ব্লকের মাঝি সৈয়দ করিম বলেন, এনজিওগুলো নলকূপ স্থাপনের পর রোহিঙ্গা মাঝিদের তত্ত্বাবধানে দেয়। এখন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কয়েক শ নলকূপ অচল পড়ে আছে। অনেক নলকূপ চালু করা যাচ্ছে না ২০-৩০ টাকা দামের একটি লেদার অথবা স্ক্রুর জন্য।

মুক্তি কক্সবাজার-এর প্রধান নির্বাহী বিমল দে সরকার বলেন, লম্বাশিয়া ও মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে তাঁরা ৬০৫ থেকে ৭৮৫ ফুট গভীরতার ৩৪টি নলকূপ স্থাপন করেছিলেন। প্রতিটি কূপের বিপরীতে খরচ হয় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। নলকূপগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রোহিঙ্গাদের। এখন নলকূপ অচলের খবর পাওয়া গেলেও সচল করার জন্য বরাদ্দ নেই।

জেলা প্রশাসনের এনজিও-বিষয়ক শাখা সূত্র জানায়, ৭ মে পর্যন্ত গত ৮ মাসে আশ্রয়শিবিরগুলোতে স্থাপন করা হয়েছে ৭ হাজার ৬৫টি নলকূপ। এর মধ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর স্থাপন করেছে ২ হাজার ৫২৮টি। অবশিষ্ট ৪ হাজার ৫৩৭টি নলকূপ স্থাপন করে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা।

উখিয়া উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, নলকূপের পাশাপাশি লাখো রোহিঙ্গার পানির চাহিদা পূরণ করতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর শুরুর দিকে দুটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী আশ্রয়শিবিরে দৈনিক ১২ হাজার লিটার খাবার পানি সরবরাহ দিত। বিভিন্ন সংস্থা সরবরাহ করত দৈনিক ৮৯ হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি। এখন পানি সরবরাহ নেই বললে চলে। ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার দৈনিক পানির চাহিদা ১ কোটি ৬০ লাখ লিটার। চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগ পানিও পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছে বিভিন্ন সূত্র।

রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, আশ্রয়শিবিরে নারীদের গোসল করা নিয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কয়েক মাস আগে শিবিরের বিভিন্ন স্থানে ত্রিপল ও বাঁশের বেড়ার গোসলখানা তৈরি হলেও এখন সব কটি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। সংস্কারের উদ্যোগ নেই।

জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, আশ্রয়শিবিরগুলোতে এ যাবৎ ১ হাজার ৭৮০টি গোসলখানা তৈরি করা হয়। এর মধ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ৪৯০টি, বাকি ১ হাজার ২৯০টি তৈরি করেছে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু এগুলোরও রক্ষণাবেক্ষণ নেই।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ঋত্বিক চৌধুরী বলেন, পানির সংকট নিরসনে আশ্রয়শিবিরে আরও এক হাজার গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এগুলোর গভীরতা হবে ৫০০-৯০০ ফুট।

উখিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জানালেন, আগে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৪০-৫০ ফুট গভীরে খাবার পানি পাওয়া যেত। এখন ৬০০ থেকে ৯০০ ফুট নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অন্তত ২ হাজার নলকূপ পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পানিসংকটের কারণে উপজেলায় চাষাবাদও ব্যাহত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসনের এনজিও-বিষয়ক শাখার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, আশ্রয়শিবিরে নলকূপ স্থাপনে অনিয়মের অভিযোগ আছে। কিন্তু লোকবল-সংকটের কারণে তদন্ত করা যাচ্ছে না। তবে অচল নলকূপগুলো সচল করে পানিসংকট দূর করার চেষ্টা চলছে।

ডায়রিয়ার চিত্র
রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা মিজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, পাহাড়ি এলাকায় বসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দূষিত পানি খেয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা ডায়ারিয়া, আমাশয়সহ নানা রোগে ভুগছে। অকেজো নলকূপগুলো সচল করা গেলে রোগ থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেত রোহিঙ্গারা।

জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্র জানায়, রোববার পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি আশ্রয়শিবিরে তীব্র ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ২ লাখ ২৮ হাজার ৬৯৩ জনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রক্ত আমাশয়ে আক্রান্ত হয়েছে আরও ৯৩ হাজার ৮ জন রোহিঙ্গা। এ ছাড়াও দূষিত পানি খেয়ে অনেকেই টাইফয়েড, হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস ই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।