এবারও চট্টগ্রাম নগর ডুববে

আধঘণ্টা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের প্রবর্তক শিশু একাডেমীর সামনের দৃশ্য। ২০ মে বেলা দুইটা।  প্রথম আলো
আধঘণ্টা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের প্রবর্তক শিশু একাডেমীর সামনের দৃশ্য। ২০ মে বেলা দুইটা। প্রথম আলো

বর্ষা মৌসুম আসন্ন। চট্টগ্রাম নগরের নালা-নর্দমা পরিষ্কারের কাজ চললেও খালগুলোর খননকাজ এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। এতে নগরজুড়ে জলাবদ্ধতার আতঙ্ক ভর করছে। গত ১৯ এপ্রিল ভোরে এবং ২১ মে সামান্য বৃষ্টিতে নগরের বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। এবার জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ গতবারের চেয়েও বেশি হবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় নগরবাসী।

নগরবাসী জলাবদ্ধতা নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও চলতি মৌসুমে তা পুরোপুরি দূর করার ব্যাপারে স্বপ্ন দেখাতে পারছেন না চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ও বিশেষজ্ঞরা।

নগরের খাল খনন নিয়ে সিটি করপোরেশন ও সিডিএর টানাটানিতে চলতি বছরেও এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএর সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করা হয় গত বছরের ৯ আগস্ট। প্রায় আট মাস পর গত ২৮ এপ্রিল নালা-নর্দমা পরিষ্কারের মাধ্যমে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বিগত বছরগুলোতে করলেও এই প্রকল্পের কারণে এবার খালগুলোর খননকাজ বন্ধ রেখেছে সিটি করপোরেশন। খননের পরও একাধিকবার বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যেত নগরের অধিকাংশ এলাকা।

এ প্রসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিডিএ প্রকল্প অনুমোদনের পর থেকে তা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামতে নামতে বর্ষা মৌসুম এসে গেল। তাই জলাবদ্ধতা নিরসনে এবার ভাববাদী হতে হবে। এখন আর আল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। জোয়ারের সময় যদি অতিবৃষ্টি হয়, তাহলে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই।’

জলাবদ্ধতা নিরসনে করপোরেশন-সিডিএ টানাপোড়েন
চট্টগ্রাম নগরে ১৫ বছর ধরে জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রকট। ২০০৭ সালের পর তা শোচনীয় অবস্থায় রূপ নেয়। গত বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই ৪ ও ২১ এপ্রিল প্রবল বৃষ্টিতে দুবার ডুবেছিল চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকা। এরপর বর্ষায় বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে নিয়মিত বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যেতে থাকে। গত বছরের ৩১ মে বৃষ্টিতে আবার ডুবে যায় নগরের বড় একটি অংশ। সেদিন থেকে টানা চার দিন (৩ জুন) ডুবে ছিল নগরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আগ্রাবাদ এক্সেস রোড। এরপর অন্তত আরও পাঁচবার প্রবল বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল নগরের বিভিন্ন এলাকা।

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা দূর করতে গত বছরের ৯ আগস্ট ৫ হাজার ৬১৬১ কোটি ৫০ লাখ টাকার বড় প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি গ্রহণ করে সিডিএ। এর বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।

জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক চুক্তি সই করে সিডিএ। এরপর গত ২৮ এপ্রিল নালা-নর্দমা পরিষ্কারের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু করে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর। তবে জলাবদ্ধতা নিরসনে আশার বাণী শোনাতে পারেননি সিডিএর চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। প্রকল্প বাস্তবায়নকাজের উদ্বোধনের সময় নগরবাসীর কাছে ‘হাত জোড়’ করে আগাম ক্ষমা চান তিনি। এই বছর বেশি প্রত্যাশা না করার অনুরোধ জানান তিনি।

সিডিএর প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুর আগে চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুতে নগরের খালগুলোর খননকাজ শুরু করেছিল সিটি করপোরেশন। কিন্তু সিডিএর কাছ থেকে স্পষ্ট জবাব না পাওয়ায় ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এসে খননকাজ বন্ধ করে দেয় তারা।

নগরের খাল খনন কার্যক্রম চালু রাখবে কি না, তার মতামত চেয়ে সিডিএ চেয়ারম্যানকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেয় সিটি করপোরেশন।
সিডিএর পক্ষ থেকে যথাসময়ে উত্তর না পাওয়ায় খননকাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে বলে দাবি করেন সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও খুব বেশি সুফল পাওয়া যাবে না। তাই প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হবে। তবে করপোরেশন হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে নালা-নর্দমা খননের জন্য ক্রাশ প্রোগ্রাম নিয়েছে। রাতারাতি জলাবদ্ধতা দূর করার ব্যাপারে জনগণকে মিথ্যা ও অর্থহীন আশ্বাস দিয়ে লাভ নেই উল্লেখ করে মেয়র বলেন, বরং এতে জনগণ উল্টো দোষারোপ করবে।

৫৭টি মূল খালসহ নগরে শাখা-প্রশাখা মিলিয়ে ১১৮টি খাল রয়েছে। এর মোট দৈর্ঘ্য ১৮২ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। বর্তমানে পাকা ও কাঁচা নালা-নর্দমা আছে যথাক্রমে ৭১০ কিলোমিটার ও ৫৫ কিলোমিটার। নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের ২২টিতেই বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে কমবেশি জলাবদ্ধতা হয়। নগরের ৬০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৩১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের বসবাস এসব ওয়ার্ডে।

সিটি করপোরেশন প্রতিবছর নগরের বিভিন্ন খাল ও নালা-নর্দমাগুলো থেকে মাটি উত্তোলন করে। গত বছর ৪১টি ওয়ার্ডের খাল ও নালা-নর্দমা থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার ৯০৭ ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করে। এতে ব্যয় হয়েছে ২৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

সিডিএর প্রকল্পে যা আছে
সিডিএর মেগা প্রকল্পের অধীনে তিন বছরে নগরের ৩৬টি খাল থেকে মাটি খনন করা হবে ৫ লাখ ২৮ হাজার ২১৪ ঘনমিটার। এ ছাড়া খালের পাড়ে ৮৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। ১৭৬ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেয়াল এবং ১০ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার নতুন নালা নির্মাণ করা হবে। সেতু ও কালভার্ট তৈরি করা হবে ৫৪টি। বন্যার পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধারা নির্মাণ করা হবে ৩টি।

সিডিএ সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে প্রাথমিকভাবে ১৫টি খাল খনন করা হবে। এগুলো হচ্ছে চাক্তাই, বির্জা, মিরজা, রাজাখালী ১, ২ ও ৩, নাছির খাল, নোয়াখাল, বাইজ্জ্য খাল, বালুখালী খাল, ডোমখালী খাল, হিজড়া খাল, চাক্তাই ডাইভারশন খাল, মহেশ ও রামপুর খাল। চলতি অর্থবছরে এই প্রকল্পের জন্য পাঁচ শ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে দেড় কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। প্রকল্পের অন্যান্য কাজ পরে শুরু করা হবে।

১৫টি খালকে চারটি প্যাকেজে ভাগ করে খনন করা হবে বলে জানিয়েছেন সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর না হলেও পরবর্তী বছর চট্টগ্রাম নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে পারবেন বলে আশাবাদী।

অনুমোদনের পর খননকাজ শুরুতে দেরি হওয়া প্রসঙ্গে সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই চেষ্টা করেছি, যত দ্রুত সম্ভব কাজ শুরু করা যায়। বিশাল এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকাজ আদৌ এ বছর শুরু হবে কি না, তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ ছিল। এখন কাজ শুরু হয়েছে।’

ময়লা-আবর্জনা ও মাটিতে ভরাট খাল
চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট মোড় থেকে শুরু হয়েছে চাক্তাই খাল। সম্প্রতি সেখান গিয়ে দেখা যায়, খালের বিভিন্ন অংশ মাটি জমেছে। এই জায়গা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে চকবাজার ধুনিরপুল অংশে চাক্তাই খালে ময়লা-আবর্জনা ও মাটির স্তর পড়েছে। এর থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে দেওয়ানবাজারে গিয়ে দেখা যায়, চাক্তাই খালের বড় অংশজুড়ে কচুরিপানা জমেছে।

নগরের ২ নম্বর গেটে চশমাখাল মাটিতে ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে আগাছা ও বিভিন্ন ধরনের ঘাস জন্মেছে। মিরজা খালের মিরজা পুল ও শুলকবহর অংশে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ও মাটির স্তূপ রয়েছে।
নগরের চকবাজার ধুনিরপুল এলাকার দুই দোকানি মোহাম্মদ মঞ্জুর আলম ও আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, চাক্তাই খালের পানিতে দোকান কয়েকবার তলিয়ে যায়। এবার এখনো খাল পরিষ্কার করা হয়নি। সামনে বৃষ্টির সময় কী হবে, তা নিয়ে এখন থেকে দুশ্চিন্তায় আছেন তাঁরা।