সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দিতে পারেনি বাংলাদেশ

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ ও জমি দখল হয়ে যাওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে চললেও পাঠ্যপুস্তকে ঐতিহ্যগত ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়গুলোয় তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে অমুসলিম লেখকদের লেখা সরিয়ে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক নেই—এমন সব বিষয়েও ধর্মীয় উপাদান যুক্ত করা হয়েছে।

২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় স্বাধীনতা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। 


আজ বুধবার ঢাকায় আমেরিকান সেন্টার থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশসহ প্রায় ২০০টি দেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে গতকাল মঙ্গলবার ‘২০১৭ আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।

বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যেমন: হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের উচ্ছেদ ও তাদের জমি দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়ে কার্যকর সুরক্ষা দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। গত বছর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। জুন মাসে দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চাকমাদের ৩০০ বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। ওই সময় ৭০ বছর বয়সী এক নারী হামলায় নিহত হন। একজন মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনা থেকে আগুন-সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে।

ফেসবুকে ইসলাম অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা রংপুরে হিন্দুদের ৩০টি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাংলা পাঠ্যপুস্তক থেকে দেশটির ঐতিহ্যগত ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়গুলোতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। যেমন অমুসলিম লেখকদের লেখা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক নেই—এমন সব বিষয়েও ধর্মীয় উপাদান যুক্ত করা হয়েছে।

এদিকে ধর্মীয় স্থান, ধর্মীয় উৎসব উদ্‌যাপনের জায়গাগুলোয় হামলার আশঙ্কা থেকে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা অব্যাহত রেখেছে সরকার।

গত বছর রাঙামাটির লংগদু উপজেলার তিনটিলা গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক চন্দ্রসুরত চাকমার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রথম আলো ফাইল
গত বছর রাঙামাটির লংগদু উপজেলার তিনটিলা গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক চন্দ্রসুরত চাকমার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রথম আলো ফাইল

প্রতিবেদনে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকারের পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশটির সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে উল্লেখ করা হলেও দেশটি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে চলে। ধর্মীয় বৈষম্য নিষিদ্ধ করে সব ধর্মের জন্য সমতার কথা বলা হয়েছে। জঙ্গিবাদ থেকে রক্ষা পেতে সরকারের বার্তা প্রচারের জন্য মসজিদের ইমামদের দিকনির্দেশনা দিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে মসজিদকে ব্যবহার করে ‘উত্তেজনামূলক’ বার্তা ছড়ানো ঠেকাতেও নজর রেখেছে সরকার। আল-কায়েদার আদর্শে উদ্বুদ্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং ২০১৫ সালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন ব্লগারকে (প্রকৌশলী, লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়) হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে গত বছরের নভেম্বর মাসে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, গ্রেপ্তার দুজনের একজন এই হত্যাসহ আরও চারজন প্রগতিশীল ব্যক্তি হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

তবে সরকারের নির্দেশ অমান্য করে, নারীদের বিচারবহির্ভূত শাস্তি ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামের নেতাশ্রেণির লোকজনকে স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা গেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিংসতার ঘটনার বিরুদ্ধে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের প্রতিনিধিরা ক্রমাগত বক্তব্য রেখেছেন এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় সরকারের কাজের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ওপর জোর দিয়ে মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা, বিশিষ্ট নাগরিক, বেসরকারি সংস্থা ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দূতাবাসের পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।

এ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, যখন ধর্ম, মতপ্রকাশ, গণমাধ্যম ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মতো মৌলিক স্বাধীনতার বিষয়ে আঘাত হানা হয়, তখনই সংঘাত, অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসবাদের মতো ঘটনাগুলো ঘটে। বিশ্বের প্রত্যেক মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা পেতে ব্যাকুল মানুষের পাশে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।