বাঘে আক্রান্ত মানুষের দুর্বিষহ জীবন

সুন্দরবনের বাঘের আক্রমণ থেকে বেঁচে ফেরা এক ব্যক্তি।
সুন্দরবনের বাঘের আক্রমণ থেকে বেঁচে ফেরা এক ব্যক্তি।

বাংলাদেশ সুন্দরবনের সবচেয়ে দক্ষিণের বসতি আংটিহারা। খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশীর সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম। গ্রামের দক্ষিণ দিকে বয়ে চলেছে শাকবাড়িয়া নদী, নদীর ওপারে সুন্দরবন।

আংটিহারা অনেকটা বন্দরের মতো। ভারতীয় জাহাজগুলো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এখানে এসে কাস্টমস সমস্যা মেটায়। কাস্টমস ছাড়াও এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি আছে, আছে ওয়াপদার ভাঙাচোরা একটি বাংলো। বাংলোর কাছেই গোবিন্দ মন্ডলের বাড়ি। এলাকার আর দশজন প্রান্তিক চাষির মতো গোবিন্দও উপরি রোজগারের জন্য চিংড়ির পোনা ধরতেন।

সেদিন বাড়ির কাছেই জঙ্গলের ধারে ভাটার সময় চিংড়ি জাল টানছিলেন গোবিন্দ, বিকেলের দিকে। কখন যে নদীর চর পার হয়ে বাঘ গোবিন্দর পেছনে পৌঁছে গেছে, তিনি টের পাননি। বাঘ যখন হাঁটুজলে ঝাঁপ দিয়ে গোবিন্দকে ঠেসে ধরেছে, তখন টের পেয়েও কিছু করার নেই তাঁর। প্রাণের দায়ে গোবিন্দ মরণপণ যুদ্ধ করতে থাকলেন বাঘের সঙ্গে। দূরে দূরে যে তিনজন গোবিন্দর সাথি ছিলেন, তাঁরা পাশের জঙ্গলে ঢুকে গাছে উঠে গেছেন। নদীর এ পাড়ে জনা দশেক নৌকায় চড়ে বসে চেষ্টা করছিলেন অকুস্থলে আসার। গোবিন্দর হাঁকডাক, নদীর এ পাড়ের লোকজন দেখে বাঘ খানিকটা ভড়কে গেল। গোবিন্দকে ছেড়ে জঙ্গলে ফিরে গেল প্রাণীটা।

সুন্দরবনে প্রতিবছরই বাঘের হাতে কিছু মানুষ মারা পড়ে। গোবিন্দর মতো কিছু মানুষ আবার বেঁচেও ফেরেন। সুন্দরবনের জঙ্গল-লাগোয়া গ্রামগুলোতে এমন বাঘে-ধরা মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। কেউ কেউ আছেন দুবার বাঘের হাতে পড়েও বেঁচে গেছেন। এ রকম বাঘে আক্রান্ত বেশ কয়েকজন মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, এ বাঁচা অভিশপ্ত জীবন নিয়ে বাঁচার মতো।

মানুষমারা বাঘ যখন কাউকে আক্রমণ করে, বাঘের প্রথম চেষ্টা থাকে থাবা মেরে মানুষটিকে ভূমির সমান্তরালে ফেলে দিতে। এই কাজে বাঘ তার প্রচণ্ড শক্তিধর সামনের পাগুলো ব্যবহার করে। সামনের থাবায় বাঘের নখর আছে পাঁচটি করে। প্রথম আক্রমণটা বাঘ সাধারণত মাথায় করে, তারপর দাঁত বসাতে যায়। দাঁত বসানোর আগ পর্যন্ত মানুষ লড়াই করতে পারে।

উদ্ধারকৃত ব্যক্তি চিকিৎসায় শরীরের অন্যান্য ক্ষত থেকে সেরে ওঠেন। কিন্তু মাথার ওপর আক্রমণে যে স্নায়ুবিক ক্ষতি হয়, সেটা বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। তার ওপর মারাত্মক হয় মানসিক ট্রমা। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার ভয়ংকর স্মৃতি কখনোই তার পিছু ছাড়ে না। বাজে পোড়া তালগাছের মতো হয় তার অবস্থা। অনেকে মাঝরাতে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। গৃহপালিত গরু-ছাগল যদি পেছন থেকে গা ঘষে দেয়, অথবা আপন সন্তান পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, তাতেই কেউ কেউ আর্তনাদ করে ওঠে। ভুলে যাওয়া, হিসাব গুলিয়ে ফেলা, সময়জ্ঞান নষ্ট হওয়া বাঘে আক্রান্ত প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাভাবিক বিকার। তার ওপর শারীরিক দুর্বলতা দৈনন্দিনের স্বাভাবিক কাজকর্মের বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

সুন্দরবন বাঁচানো, বাঘ সংরক্ষণের কথা বলি আমরা অনেক তালি বাজিয়ে। কিন্তু বাঘে আক্রান্ত (বেঁচে যাওয়া অথবা বাঘের হাতে মারা পড়া) মানুষ সম্পর্কে আমরা উদাসীন। বাঘ সংরক্ষণ করতে হলে তৃণমূলের এই সমস্যা আমলে আনতে হবে। পুনর্বাসন করতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে।