পুরোনো নির্যাতন থেকে ক্ষোভের বিস্ফোরণ

ইফফাতের বিরুদ্ধে ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর প্রতিবাদে ওই রাতে হলের বিভিন্ন কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসা সাধারণ ছাত্রীদের একাংশ। ফাইল ছবি
ইফফাতের বিরুদ্ধে ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর প্রতিবাদে ওই রাতে হলের বিভিন্ন কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসা সাধারণ ছাত্রীদের একাংশ। ফাইল ছবি
>
  • সুফিয়া কামাল হলের ঘটনা
  • ছাত্রলীগ নেত্রী ইফফাত বহিষ্কার হয়েছেন, বহালও হয়েছেন।
  • এখন ২৫ সাধারণ ছাত্রীকে জবাবদিহি করতে বলেছে হল প্রশাসন।

কক্ষে লাল পোকা (কেন্নো) দেখে মধ্যরাতে চিৎকার করে উঠেছিলেন কবি সুফিয়া কামাল হলের এক ছাত্রী। অন্যান্য কক্ষে থাকা ছাত্রীরা ধরে নিয়েছিলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশে নেওয়ার জন্য কাউকে পেটানো হচ্ছে। উত্তেজিত হয়ে সবাই একযোগে ছুটে যান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহানের কক্ষের দিকে। এরপর যা ঘটে যায়, তা লঙ্কাকাণ্ডের চেয়ে কম কিছু নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে গত ১০ এপ্রিল রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে এই তথ্য। ইফফাতের ওপর ওই দিন ছাত্রীদের চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার কারণ খুঁজতে গিয়ে এ-ও জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে ঠিক আগের দিন তিনি বিভিন্ন বর্ষের ছাত্রীদের নিজ কক্ষে ডেকে নির্যাতন করেন। দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে তাঁর নিজের দড়িলাফের দড়ি দিয়ে পেটান, দুজনকে চড়-থাপ্পড় দেন এবং পাঁচ-ছয়জনকে কনিষ্ঠ ছাত্রীদের সামনে কান ধরে ওঠবস করান।

সুফিয়া কামাল হলের ওই দিনের ঘটনার পর ১৯ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বিভ্রান্তিকর পোস্ট’ দেওয়ার অভিযোগে ছাত্রীদের মুঠোফোন তল্লাশি করে হল কর্তৃপক্ষ। মধ্যরাতে বের করে দেওয়া হয় তিন ছাত্রীকে। তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে ওই ছাত্রীদের ফিরিয়ে আনে হল কর্তৃপক্ষ। ঘটনার পর পর ইফফাতকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করলেও পরে তা প্রত্যাহার করে সংগঠনটি। ঠিক একই পন্থায় সিদ্ধান্ত বদল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। ঘটনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া তখন উল্টো দিকে মোড় নেয়। ২৪ জনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। এই তালিকার ২০ জনসহ ২৫ ছাত্রীর বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আনা হয় ইফফাতকে ‘পরিকল্পিতভাবে লাঞ্ছিত ও মারধরের’ অভিযোগ। সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণে ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই ‘মিলকে’ প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন হলের ছাত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। তাঁরা বলছেন, নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইফফাতের বিরুদ্ধে আনা নির্যাতনের অন্যান্য অভিযোগ আমলে নিত।

গত পৌনে দুই মাসে সুফিয়া কামাল হলের ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সব পক্ষের ১৮ জন ছাত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলোর। এ ছাড়া হলের দুজন আবাসিক শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত প্রক্টরিয়াল টিমের দুজন শিক্ষক, একাডেমিক কাউন্সিলের দুজন সদস্যের কাছেও ঘটনা এবং এর পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবস্থান নিয়ে কথা হয়েছে এ দুই প্রতিবেদকের। হলের ছাত্রীরা হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভয়ে নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। আর শিক্ষকেরা নাম অপ্রকাশিত রাখতে অনুরোধ করেছেন ঘটনার ‘স্পর্শকাতরতার’ অজুহাতে।

২৩ এপ্রিল ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ইফফাত জাহান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন তিনি নিজ কক্ষে আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ভাত খাচ্ছিলেন। এ সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রীরা হলের আরও কিছু ‘স্বার্থান্বেষী’ ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর কক্ষে অতর্কিত হামলা করেন। তাঁরা তাঁর কক্ষের দরজা ভেঙে ফেলেন, জানালায় লাথি মারেন। কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে তিন দফায় পেটান, জুতার মালা পরান এবং একপর্যায়ে গায়ের জামাও ছিঁড়ে ফেলেন। তাঁর দাবি, হত্যার উদ্দেশ্যেই তাঁর ওপর এমন হামলা করা হয়েছিল।

সুফিয়া কামাল হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা রহমান। যুব মহিলা লীগের কার্যনির্বাহী সদস্যও তিনি। ছাত্রীদের ওই দিন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার কারণ শনাক্ত হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেন এমনটা করল, সেটা ছাত্রীরাই ভালো বলতে পারবেন। ঘটনার দিনে কারও রগ কাটা হয়েছিল কি না, সেটিও কেবল তাঁরা তদন্ত করে দেখেছেন।

ঘটনার শুরু
চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ৮ এপ্রিল দুপুরে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। রাত পৌনে আটটায় পুলিশ তাঁদের ওপর অতর্কিত হামলা করলে সংঘর্ষ বাধে। ছাত্রদের ওপর হামলার খবরে একপর্যায়ে রাত দুইটার দিকে বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রীরা বের হয়ে আসেন, যার মধ্যে ছিলেন সুফিয়া কামাল হলেরও কয়েক শ ছাত্রী।

প্রায় প্রত্যেক ছাত্রী বলেছেন, ছাত্রীরা যখন হল থেকে বের হয়ে আসেন, তখন ইফফাত জাহান তাঁর অনুসারীদের বের না হওয়ার নির্দেশ দেন। তখন ভয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা হলে থেকে যান। কিন্তু অন্যরা তাঁর কথা অমান্য করে আন্দোলনে অংশ নেন। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হন ইফফাত। সকালে কয়েকজন ছাত্রীকে নিজ কক্ষে ডেকে গালিগালাজ ও হুমকি-ধমকি দেন।

ছাত্রীরা বলেন, পরদিন কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগ। ইফফাত তাঁর অনুসারীদের জোর করে নিয়ে যান সেই সংবাদ সম্মেলনে। কিন্তু যাওয়া ও আসার পথে কিছু ছাত্রী সটকে পড়ে আন্দোলনে অংশ নেন। বিষয়টি আরও খেপিয়ে তোলে ইফফাতকে।

ইফফাতের কক্ষে বসে বিচার
রাতে ও দিনে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রীদের ৯ এপ্রিল রাতে নিজ কক্ষে ডাকেন ইফফাত জাহান। রাত সাড়ে ১০টার দিকে শুরু হয় তাঁদের ‘বিচার’। ইফফাত ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

ওই দিন কক্ষে থাকা এক ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া ৩০৯ নম্বর কক্ষের দুজন ছাত্রীকে ডাকা হয়। তাঁদের একজনকে তিনি তরকারি গরম করার জন্য রান্নাঘরে পাঠান। আর অন্যজনকে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য শাসাতে থাকেন। ছাত্রীটি তাঁর কথার পিঠে কথা বললে একপর্যায়ে চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ইফফাত। তিনি তাঁকে দড়িলাফের দড়ি দিয়ে বাড়ি দেন। এই ঘটনার কিছুক্ষণ পর ইফফাত তাঁর অনুসারী প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের আরও শিক্ষার্থীকে ডেকে পাঠান কক্ষে।

ওই দিন ইফফাতের হাতে মার খাওয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, ইফফাত এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন যে তিনি সবাইকে খিস্তিখেউড় করা শুরু করেন। মা-বাবা তুলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন কথায় কথায়। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে তিনি দ্বিতীয় বর্ষের দুজন ছাত্রীকে চড় মারেন। পাঁচ-ছয়জন শিক্ষার্থীকে কক্ষের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সামনেই কান ধরে ওঠবস করান।

ওই দিন কক্ষটিতে জড়ো হওয়া ছাত্রীদের কেউ একজন ইফফাতের ওই দিনের গালিগালাজ ও হুমকি-ধমকির ৫ মিনিট ১১ সেকেন্ডের একটি অডিও রেকর্ড করে রাখেন। ঘটনার পরপরই তা হলে ছড়িয়ে পড়ে।

মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে ইফফাত প্রথম আলোর কাছে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে ইস্যু সৃষ্টি করার জন্যই ছাত্রীরা এসব কথা ছড়িয়েছিলেন। অডিও ক্লিপের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘ওরা অনেক ভুয়া কিছু বের করেছে। ওটা আমার না। আমি মারিনি কাউকে।’

একটি চিৎকার ও একযোগে হামলা
ছাত্রীরা বলেন, ৯ এপ্রিল রাতে ইফফাতের কক্ষের এসব ঘটনা নিয়ে ১০ এপ্রিল দিনভর হলে গুঞ্জন চলতে থাকে। কিন্তু ১০ এপ্রিলও ছাত্রীরা আন্দোলনে যান। সাধারণ ছাত্রীরা এটা ধরে নেন যে ওই দিন রাতেও আগের দিনের মতোই ইফফাত তাঁর কক্ষে ছাত্রীদের ডাকবেন। হলের এই যখন পরিস্থিতি, তখন রাত ১১টা ৫০ থেকে ৫৫-এর দিকে ইফফাতের কক্ষের (প্রত্যয় ভবনের ৩০৭ নম্বর কক্ষ) দিক থেকে একটি চিৎকার আসে। রাতের নীরবতায় এই চিৎকার বিকট আকারে শোনা যায় অন্যান্য কক্ষ থেকে। ছাত্রীরা ছুটে যান ইফফাতের কক্ষের দিকে। কেউ কেউ সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্রী নির্যাতনের পোস্ট দিয়ে দেন ফেসবুকে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, চিৎকারটি এসেছিল ইফফাতের ঠিক পাশের কক্ষ (প্রত্যয় ভবনের ৩০৮ নম্বর কক্ষ) থেকে। লাল পোকা (কেন্নো) দেখে ওই কক্ষের বাসিন্দা রোমানা আক্তার চিৎকারটি দিয়েছিলেন। রোমানা হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ইফফাতেরই অনুসারী। ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত অন্তত ১০ জন এ বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই দিন ওই সময় ইফফাতের কক্ষে থাকা এক ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ইফফাতের কক্ষে তখন তিনি ও তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ সাত-আটজন গোল হয়ে বসে ছিলেন। তাঁদের সামনে ছিলেন আন্দোলনে অংশ নেওয়া দ্বিতীয় বর্ষের দুজন ছাত্রী। তাঁদের সঙ্গে মাত্রই কথাবার্তা শুরু হয়েছে। এমন সময়ই চিৎকারটা আসে। ইফফাতসহ তাঁরা সবাই কক্ষ থেকে বের হয়ে পাশের কক্ষে যান। পোকা দেখে ভয় পাওয়া ছাত্রীটিকে শান্ত করেন।

আরেক ছাত্রী বলেন, চিৎকারের কয়েক মিনিট পরই দলে দলে ছাত্রীরা ইফফাতের কক্ষের দিকে আসতে শুরু করেন। ছাত্রীদের সংখ্যা যখন বেড়ে যাচ্ছিল, ইফফাত ভয় পেয়ে তাঁর কক্ষে অবস্থান নেন। ভেতর থেকে তিনি পোকার কথা বললেও কেউ আর তা বিশ্বাস করেননি।

রোমানা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ পোকাটি বের হওয়ায় তিনি ভয় পেয়ে চিৎকার করেছিলেন। তবে তাঁর দাবি, ছাত্রীদের হামলা পূর্বপরিকল্পিত ছিল। চিৎকারকে তাঁরা শুধু অজুহাত হিসেবে নিয়েছিলেন।

ইফফাতের নিপীড়ন ও রক্তাক্ত পা
হলের ছাত্রীরা বলেন, প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া কোনো শিক্ষার্থী হলে উঠতে চাইলে তাঁকে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে উঠতে হয়। এই দুজন বিভিন্ন কক্ষে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন। বিনিময়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাঁরা অংশ নেন।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছয়জন শিক্ষার্থী প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেছেন, ইফফাতের মাধ্যমে যেসব শিক্ষার্থী হলে উঠতেন, তাঁদের তিনি নানাভাবে নিপীড়ন করতেন। ওই ছাত্রীদের দিয়ে তিনি তাঁর ঘর পরিষ্কার করানো, রান্না করানো থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত নানা কাজ করাতেন। এ ছাড়া কখনো কেউ কর্মসূচিতে যেতে না পারলে বা তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বললে তিনি তাঁদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন। তাঁর কথামতো না চলায় দুজন শিক্ষার্থীকে তিনি মাস ছয়েক আগে হল থেকেও বের করে দিয়েছিলেন।

চিৎকার শুনে ওই দিন যেসব ছাত্রী ইফফাতের কক্ষের সামনে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুরশেদা খানমও ছিলেন। ক্ষিপ্ত হয়ে ইফফাতের কক্ষের জানালায় লাথি দিলে তাঁর পা কেটে গিয়েছিল। হলের ছাত্রীদের কেউ কেউ মুরশেদার সেই পায়ের ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করেন। তাঁরা লিখেছিলেন, ইফফাত মেয়েটির পায়ের রগ কেটে দিয়েছেন।

ঘটনার কয়েক দিন পর মুরশেদার সঙ্গে যোগাযোগ করলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ইফফাতের সঙ্গে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল না। তাঁর নিপীড়নের কথা দীর্ঘদিন ধরে কনিষ্ঠ ছাত্রীরা তাঁদের বলে আসছিলেন। ওই দিন চিৎকার শুনে অন্যদের মতো তিনিও ভেবেছিলেন কাউকে ইফফাত মারছেন। এ জন্যই তিনি রেগে গিয়ে জানালায় লাথি দিয়েছিলেন।

ইফফাতের নির্যাতনের বিষয়টি জানতেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রাধ্যক্ষ সাবিতা রিজওয়ানা রহমান বলেন, ওই দিনের ঘটনার আগে কখনোই তাঁর বিরুদ্ধে ‘লিখিত বা মৌখিক’ কোনোভাবেই এমন অভিযোগ তাঁর কাছে আসেনি।

ছাত্রলীগের পথেই এগোচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত?
ঘটনার দিন রাতেই হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ইফফাত জাহানকে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ। এর কিছুক্ষণ পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তাঁকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন উপাচার্য। ঘটনা তদন্তে ১২ এপ্রিল তদন্ত কমিটি গঠন করে ছাত্রলীগ। পরদিন ১৩ এপ্রিল ইফফাতের বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয় তারা। বলা হয়, তদন্তে ইফফাত নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। এর পাঁচ দিনের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ইফফাতের বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, তদন্তে প্রাথমিকভাবে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন।

ঘটনার বিষয়ে ছাত্রলীগের তদন্তের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অদ্ভুত সাদৃশ্য মেলে কারণ দর্শানো নোটিশে। ছাত্রলীগ ১৬ এপ্রিল ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সংগঠন থেকে ২৪ জনকে বহিষ্কার করে। এর এক মাস পর ১৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইফফাত জাহানকে ‘পরিকল্পিতভাবে লাঞ্ছিত ও মারধর করার অপরাধে’ ২৫ জন ছাত্রীকে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠায় হল কর্তৃপক্ষ ও প্রক্টরের কার্যালয়। ছাত্রলীগের বহিষ্কারের তালিকা ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কারণ দর্শানো নোটিশের তালিকা মিলিয়ে দেখা যায়, ছাত্রলীগের তালিকার ২০ জন রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রাব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই তালিকায় নামের মিল পাওয়া গেলে এটা আমাদের “হেডেকের” বিষয় না। এটা “কোইনসিডেন্স” হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের মতো তদন্ত করেছে।’ তদন্ত নিরপেক্ষ না হওয়ার বিষয়ে ছাত্রীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রক্টর বলেন, ছাত্রীদের এমনটা মনে হলে তাঁরা কারণ দর্শানোর নোটিশের উত্তরে তা উল্লেখ করতে পারেন।

সুফিয়া কামাল হলের ওই দিনের ঘটনা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরিবর্তনশীল অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত এবং অন্যান্য গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, সেদিন হলটির অসংখ্য ছাত্রী হল শাখা সভাপতি ইফফাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কোন পরিপ্রেক্ষিতে সেদিনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা শনাক্ত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হওয়া উচিত। ২৫ জন ছাত্রীকে যে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠানো হয়েছে, কী ভিত্তিতে এবং কীভাবে তদন্ত করে এই কজন ছাত্রীকেই শনাক্ত করা হয়েছে, সেটিও স্বচ্ছ নয়। তাঁর মতে, সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ ছাড়া শিক্ষার্থীকে বিপত্তির সম্মুখীন করা, কোনোক্রমেই শিক্ষক ও অভিভাবকসুলভ অবস্থান হতে পারে না।