দিনে ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পড়ছে

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।
  • বর্জ্যের উৎস গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ
  • বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা হয়ে এগুলো সাগরে যায়
  • বাংলাদেশে এককভাবে দিনে তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়

প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। পরিমাণের দিক থেকে এটি বিশ্বে পঞ্চম।

এই বর্জ্যের উৎস গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা হয়ে এগুলো সাগরে যায়।
চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি প্রকাশিত ‘বিশ্বের প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিস্থিতি’ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস (আজ) উপলক্ষে তারা ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণকে পরাস্ত কর’।

ইউএনইপির হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিদিন তিন কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর ৮০ লাখ টন প্রধান ১০টি নদী অববাহিকা দিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ছে। এই ১০ নদীর আটটিরই উৎসস্থল চীন। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দূষণের প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও আছে।

তবে বাংলাদেশে এককভাবে দিনে তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। এর মাত্র কিছু অংশ নদী দিয়ে সাগরে যায়। বাকি বর্জ্য এবং গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দেশ থেকে আসা বিপুল প্লাস্টিক বর্জ্যের একটি অংশ দেশের বিভিন্ন নদ-নদী এবং ভূভাগকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। এতে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি হচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডিও)-এর করা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জলে-স্থলে বর্তমানে ৬৫ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে। প্রতিদিন এর সঙ্গে তিন হাজার টন করে যোগ হচ্ছে। সংস্থাটি দেশের পরিবেশের জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি হিসেবে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগকে চিহ্নিত করেছে। তারা বলছে, দেশে যেখানে জৈব বর্জ্য বৃদ্ধির হার পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ। সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যের বৃদ্ধির হার সাড়ে সাত শতাংশ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক জেনেও দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছে।

এসডিও-এর ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ব্যবহৃত হওয়া বেশির ভাগ প্লাস্টিক মাটি ও পানিতে গিয়ে জমা হয়। এগুলো আলাদা করে সংগ্রহ ও পুনঃব্যবহারের কোনো প্রক্রিয়া নেই। এগুলো মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক ডাই-অক্সিন ও হাইড্রোজেন সায়ানাইড তৈরি করে। যা উদ্ভিদ ও মাছের সঙ্গে মিশে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে।

এসডিও-এর গবেষণা অনুযায়ী, প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে অ্যাজমা, ফুসফুসের ক্যানসার, পাকস্থলীর সমস্যা, চর্মরোগ বাড়ছে। মাছ এবং গৃহপালিত প্রাণীর পেটেও প্লাস্টিকের গুঁড়ো পেয়েছে সংস্থাটির গবেষক দল।

দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পর্কে এসডিও-এর মহাসচিব শাহরিয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আমাদের দেশে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১০ সালে পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যাগ ব্যবহারে আইন হয়। কিন্তু পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার দিনকে দিন বাড়ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পণ্যের মিনি প্যাক মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। এগুলো বর্জ্য হিসেবে পরিবেশ বিষাক্ত করার পাশাপাশি রাজধানীর বেশির ভাগ নালা ও খালের পানি যাওয়ার পথ আটকে দিচ্ছে।

কাগজে-কলমে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে পলিথিন ব্যাগ তৈরির শতাধিক কারখানা রয়েছে। রাজধানীর লালবাগ, হাজারীবাগ, সদরঘাট, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে এসব কারখানা বহাল তবিয়তে নিষিদ্ধ পণ্য উৎপাদন করে যাচ্ছে। বাজারেও এর ব্যবহার প্রায় স্বাভাবিক।

জীবনের প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী এই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সুলতান আহমেদ গতানুগতিক বক্তব্যই দিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে আমরা অন্যান্য সরকারি সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। পলিথিন ব্যাগের কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান আরও জোরদার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’

পলিথিন বন্ধে ও দেশের পাটশিল্প রক্ষায় ২০১০ সালে সরকার পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন করেছে। কিন্তু ওই আইনের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ এখনো হয়নি। শুধু খাদ্য অধিদপ্তর ও চাল ব্যবসায়ীরা পাটের ব্যাগ ব্যবহার করত। গত বছরের আগস্টে দেশে চালের দাম বেড়ে গেলে চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা দাম কমানোর লোভ দেখিয়ে পাটের ব্যাগের পরিবর্তে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহারের দাবি তোলেন। ১০ মাস ধরে এই খাতে পাটের বস্তার ব্যবহারও বন্ধ হয়ে আছে।