জিপিএ-৫ পেয়েও পড়াশোনা নিয়ে অনিশ্চয়তা এরিনা-নাছরিনের

এরিনা বেগম
এরিনা বেগম

দুজনেরই বাবা নেই। কষ্টের সংসারে বড় হয়েছে তারা। তবু পড়াশোনা থামায়নি। খেয়ে না খেয়ে স্কুল করেছে। ছিল না বই কেনার ও ফরম পূরণের টাকা। ধার করে টাকা নিয়ে ফরম পূরণ করে তারা উভয়ে এবার এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছে। কিন্তু এখনো সেই ধার করা টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। জিপিএ ৫ পাওয়াটা তাদের কাছে তাই জঞ্জালই বটে! কারণ একটাই, এখন কলেজে ভর্তি হওয়া ও থাকা–খাওয়ার টাকা পাবে কোথায়? এমন দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হয়েছে দুই মেধাবী ছাত্রী এরিনা বেগম ও নাছরিন আক্তারের। বাবাহীন এই দুই ছাত্রীর মায়েরাও আছেন বড় চিন্তায়।

এরিনার বাবা ইলিয়াছ মিয়া মারা গেছেন নয় বছর আগে। মা ফেরদৌসি বেগম মেয়েকে নিয়ে পড়েন অকূলপাথারে। স্বামীর রেখে যাওয়া ৫৫ শতক আবাদি জমি চাষের জন্য লাঙল-কোদাল নিয়ে তিনি নিজেই মাঠে নামেন। আর মেয়ে এরিনাকে ভর্তি করে দেন স্কুলে। জীবনের সব কষ্ট অতিক্রম করে সেই এরিনা এবার এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে সব বিষয়ে জিপিএ–৫ পেয়েছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও বৃত্তি পেয়েছিল সে।

এই অদম্য মেধাবী ছাত্রীর বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার লোহানীপাড়া ইউনিয়নের মোসলমারী গ্রামে। ফিজুর রহমান নামে এরিনার এক ভাই ছিল। আট বছর বয়সে ফিজু মারা যায়। ছেলের মৃত্যু শোকে বাবা ইলিয়াছ মিয়া শয্যাশায়ী হয়ে পড়ার পর আর সুস্থ হননি। ২০০৮ সালে তিনিও পরপারে চলে যান। সম্পদ বলতে রেখে যান ওই ৫৫ শতক দোলা জমি ও একটি টিনের ঘর।

জীবন সংগ্রামী মেয়ে এরিনা বলে, বাবার আদর স্নেহ পেলেও সে কথা মনে নেই। মা আমার সব। বাড়ি থেকে ৭-৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ছড়ান দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে মা আমাকে ভর্তি করে দেন। রিকশা-ভ্যানে যাওয়া আসার টাকা না থাকায় দীর্ঘদিন হেঁটে এবং পরে একটি পুরোনা বাইসাইকেল কিনে দিলে তা চালিয়ে স্কুল করেছি। ভালো জামা কাপড় ও ঠিকমতো খাবার পাইনি, নতুন বই কিনতে পারিনি। বাবা না থাকায় আর্থিক কষ্টে ভরা মায়ের মুখখানি দেখলে খুব খারাপ লাগে।’ এরপর থেমে যায় এরিনার কথা। ভারী হয়ে ওঠে তাঁর কণ্ঠ।

এরিনার মা ফেরদৌসি বেগম বলেন, ‘ও পড়তে চায়। বাড়ির পাশের একজনের কাছে দুই হাজার টাকা ধার নিয়া মেয়েটার ফরম পূরণ করাইছিলাম। সেই টাকা এখনো দিতে পারি নাই। এখন বাইরের কলেজে ভর্তি ও থাকা খাওয়ার টাকা কই পাব?’ এরপর শাড়ির আঁচলে চোখ মোছেন তিনি, দুঃখ-কষ্টের কথা আর বলতেই পারলেন না। এরিনার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইয়াকিন আলী বলেন, ‘এরিনা অভাবী পরিবারের মেধাবী মেয়ে। পড়াশোনা করার সুযোগ পেলে জীবনে সে অনেক ভালো কিছু করতে পারবে।’
এরিনার মায়ের প্রত্যাশা সমাজের বিত্তবান মানুষ এগিয়ে আসবেন তাঁর মেয়ের পড়াশোনা এগিয়ে নিতে। এরিনাকে সহায়তার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন কিংবা বিকাশ করতে পারেন এই নম্বরে: ০১৭২২-৭৪২৯৫৬।

নাছরিন আক্তার
নাছরিন আক্তার

নাছরিনের মা নাসিমা বেগম। নিজের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে কেঁদে ফেললেন—‘ আট বছর আগে মুই বিধুয়া (বিধবা) হচুন। একটা ছেলে আছলো পাঁচ বছর আগোত তাকও হারাছুন। মাইনসের বাড়িত কাম করি মেয়েটাক খাওয়াছুন। মাইনসের কাছোত এক হাজার আট শ টাকা ধার নিয়া ওর ফরম ফিলাপ করাছুং। তাক এ্যালাও শোধ দিবার পাও নাই। ওক কলেজোত পড়ার খরচ কোনটে পাইম?’

নাছরিন পাগলাপীর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৫ পেয়েছে। সে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও জিপিএ–৫ পায়। তারাগঞ্জ উপজেলা থেকে সাত কিলোমিটার ও রংপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে তার বাড়ি। সহায়-সম্বল বলতে পাঁচ শতক জমির ওপর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি টিনের ঘর।

হরিদেবপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (ইউপি) জাদু মিয়া বলেন, ‘নাছরিনদের কোনো জমি-জমা নেই। অন্যের বাড়িতে নাছরিনের মা কাজ করেন। তাঁদের কষ্ট দেখে আমি ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড করে দিয়েছি।’

দারিদ্র্য ও কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে চলা নাছরিন আক্তার বলে, ‘টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছি। নতুন জামা কেনার টাকা ছিল না। তাই পুরাতন জামা গায়ে দিয়ে এবং পরীক্ষার প্রথম দিন বাসি ভাত খেয়ে পরীক্ষা দিয়েছি।’ এরপর চোখ মোছে নাছরিন। বলে, ‘আমার ইচ্ছা ডাক্তার হওয়ার, কিন্তু সাধ থাকলেও লেখাপড়া করানোর সাধ্য নেই মায়ের। এখন টাকার অভাবে পড়াশোনা করা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছি আমি।’

পাগলাপীর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘মেয়েটার পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতই খারাপ যে ওর কাছে স্কুলের বেতন নেওয়া হয়নি। মেয়েটা অনেক মেধাবী।’ আর্থিক কষ্টে জর্জরিত নাছরিনের পাশে কেউ এসে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবেন এমন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তাঁর মা নাসিমা বেগম। নাছরিনকে সহায়তার জন্য বিকাশ নম্বর: ০১৭৪০-৩৩৩১১৮।