হঠাৎ ইঞ্জিন বিকল নিয়ে দুশ্চিন্তা

এমনিতেই রেলে ইঞ্জিন-সংকট প্রবল। এর মধ্যে এ বছর পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে চলন্ত অবস্থায় হঠাৎ ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনা আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বিষয়টি দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে রেলকর্তাদের। এ অবস্থায় ঈদযাত্রায় ভোগান্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, বহরে নতুন ইঞ্জিন যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ভোগান্তির মাত্রা কমবে না। আর দুই বছরের আগে নতুন ইঞ্জিন যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
রেলের দায়িত্বশীল একজন যান্ত্রিক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পুরোনো ইঞ্জিন জোড়াতালি দিয়ে চালু রাখা হয়েছে। ফলে চলন্ত ট্রেন হঠাৎ বন্ধ হচ্ছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, নতুন ইঞ্জিন বহরে যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ‘যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির’ মতো ট্রেন চালাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সীমিত সম্পদ দিয়ে রেলওয়ে সর্বোচ্চ সেবা দিচ্ছে। ঈদযাত্রায়ও দেবে।
গতকাল রোববার থেকে শুরু হয়েছে রেলে ঈদযাত্রা। চলবে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত।
পূর্বাঞ্চলে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগ নিয়ে গঠিত) ২৩ জোড়া এবং পশ্চিমাঞ্চলে (রাজশাহী, খুলনা, রংপুর বিভাগ নিয়ে গঠিত) ২০ জোড়া আন্তনগর ট্রেনে যাত্রী পরিবহন হয়। এ ছাড়া মেইল, এক্সপ্রেস ও লোকাল ট্রেনেও যাত্রী পরিবহন হয়। প্রতিবছর ঈদযাত্রার সময় দেশের বিরতিহীন
সুবর্ণ ও সোনার বাংলা ছাড়া বাকি ৪১ জোড়া ট্রেনে আসনের বাইরে দুই-আড়াই গুণ বেশি যাত্রী পরিবহন হয়ে আসছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, পূর্বাঞ্চল রেলে গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় এ বছরের প্রথম পাঁচ
মাসে চলন্ত ট্রেনের ইঞ্জিন ৯২ শতাংশ বেশি বিকল হয়েছে। যেমন চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলে পাঁচ মাসে বিভিন্ন ট্রেনের ইঞ্জিন
মোট ১৪৮ বার বিকল হয়। অথচ গত বছরের
১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বিকল হয়েছিল
৭৭ বার।
রেলের নথি থেকে জানা গেছে, আন্তনগর, মেইল, লোকাল এবং পণ্যবাহীসহ সব শ্রেণির ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হচ্ছে। এতে এক ঘণ্টা থেকে সোয়া পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত যাত্রা বিলম্ব ঘটছে।
পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলিয়ে বর্তমানে
রেলের বহরে নতুন-পুরোনো মিলে সচল ইঞ্জিন রয়েছে ২৭২টি, যার ৭২ শতাংশের মেয়াদ পার হয়ে
গেছে। সাধারণত, একটি ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল ২০-২২ বছর ধরা হয়। তবে এই ইঞ্জিনগুলো এখন মেরামত করে চলছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী
মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন,
পূর্বাঞ্চলে পুরোপুরি সক্ষম ইঞ্জিন ৩৯টি। যদিও প্রয়োজন ১৫০টির মতো। পূর্বাঞ্চলে মোটামুটি সক্ষম ইঞ্জিন ২১টি।
রেলওয়ের মহাপরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, পশ্চিমাঞ্চলে পুরোপুরি সক্ষম ইঞ্জিন আছে ২৬টি। আর মোটামুটি সক্ষম ইঞ্জিন ১১টি।
রেলওয়ের যান্ত্রিক প্রকৌশলীরা বলছেন, একটি ইঞ্জিন ওভারহোলিং (বড় আকারের মেরামত) করে সক্ষম করা যায়। সচল ২৭২ ইঞ্জিনের মধ্যে ১১টি ১৯৫৩ সালে তৈরি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা এসব ইঞ্জিন এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। এই পুরোনো ইঞ্জিনই ভোগাচ্ছে রেলকে।
রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে পাঁচটি এবং পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে আরও নতুন পাঁচটি ইঞ্জিন যুক্ত হবে। আগামী পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে আরও ৭০টি ইঞ্জিন এবং এক বছরের মধ্যে আরও ৪০ ইঞ্জিন আনার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে। তখন রেলে ইঞ্জিন-সংকট থাকবে না।
তবে রেলের দায়িত্বশীল একজন যান্ত্রিক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করে জানান, আগামী ২২-২৩ মাসের আগে নতুন ইঞ্জিন যুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন আনতে মাসখানেক আগে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়। চুক্তির ২৪ মাসের মধ্যে ইঞ্জিন সরবরাহ দেওয়া হবে।

ইঞ্জিন বিকলের খণ্ডচিত্র
রেলওয়ে নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে একটি করে ইঞ্জিন বিকল হচ্ছে। এতে অভিজাত শ্রেণির ট্রেনও বাদ পড়ছে না।
নিয়ন্ত্রণকক্ষের নথি ঘেঁটে জানা গেছে, গত ২২ মে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দ্বিতীয় বিরতিহীন অভিজাত ট্রেন সোনার বাংলার ইঞ্জিন ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে বিকল হয়। এতে ওই দিন ১ ঘণ্টা ২৪ মিনিট যাত্রা বিলম্ব ঘটে। গত ২১ মে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মহানগর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ফৌজদারহাট-কুমিরা স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় বিকল হলে তিন ঘণ্টা চলাচল বন্ধ থাকে। গত ৫ মে ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রেলপথের এগারসিন্দুর ইঞ্জিন ভৈরববাজারে বিকল হলে ২ ঘণ্টা ১০ মিনিট যাত্রা বিলম্ব ঘটে।
একইভাবে ঢাকা-মোহনগঞ্জ রেলপথে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ৬ জুন ময়মনসিংহ-গৌরীপুর স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় হঠাৎ বিকল হয়। এতে ওই দিন ৫৫ মিনিট ট্রেনের যাত্রা বিলম্ব ঘটে। একই দিন চট্টগ্রাম-বঙ্গবন্ধু সেতু রেলপথের ময়মনসিংহ এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন কুমিল্লার শর্শদী এলাকায় বিকল হয়। এতে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট যাত্রা বিলম্ব হয়। ৪ জুন ঢাকা-মোহনগঞ্জ রেলপথের হাওর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন বিকল হলে দেড় ঘণ্টা যাত্রা বিলম্ব ঘটে।