পথ অরক্ষিত, ইয়াবা আসছেই

ইয়াবা পাচার ঠেকাতে নাফ নদীতে কোস্টগার্ড ও বিজিবির নিরাপত্তাব্যবস্থা যথেষ্ট কি না, সে প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত এই নদীতে প্রায় চার হাজার মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার চলাচল করে। এর মধ্যে কিছু নৌকা ও ট্রলারে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসে। মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার তিন সপ্তাহ পরও নাফ নদীতে ইয়াবা পাচার ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত সমন্বিত কোনো অভিযান চালায়নি।

অন্যদিকে স্থলভাগেও মাদক পাচার ঠেকাতে বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশের যৌথ কার্যক্রম নেই। ফলে নদীতে হাতবদল হওয়া ইয়াবা টেকনাফ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। বিভিন্ন সংস্থা যে যার মতো করে নদীতে অভিযান চালানোয় কার্যকর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা।

নাফ নদীর এক পাড়ে বাংলাদেশের টেকনাফ, অন্য পাড়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর। এই নদীর ৫৮ কিলোমিটার অংশে দুই দেশের জলসীমা রয়েছে। এর মধ্যে ৫৪ কিলোমিটার টেকনাফে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, নাফ নদী বরাবর সীমান্তে (টেকনাফের উল্টো দিকে) কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে মিয়ানমার। কিন্তু বাংলাদেশ অংশে সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেই। টেকনাফের হোয়াইক্যং থেকে শাহপরীর দ্বীপের বদরমোকাম পর্যন্ত নাফ নদীর ৫৪ কিলোমিটার অংশে সড়ক নির্মাণ করা গেলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড ও পুলিশের নজরদারি বাড়ানো যেত। এতে ইয়াবা পাচার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো। তাঁরা বলেন, মিয়ানমার সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর জন্য সড়ক নির্মাণ করেছে ভারতও। সে কারণে মিয়ানমার থেকে ভারতে সরাসরি ইয়াবা পাচার করা কঠিন।

বিজিবি সূত্র জানায়, মিয়ানমার সীমান্তের ১০ কিলোমিটার ভেতরেও বাংলাদেশের বিভিন্ন মুঠোফোন কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে দুই দেশের পাচারকারীরা নিজেদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করেন। এমনকি সীমান্তের অবস্থাও আগে থেকে জেনে যায় পাচারকারীরা।
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আছাদুজ্জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্ত সুর‌ক্ষিত করতে যতগুলো চাহিদা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো নাফ নদী ঘিরে রিং রোড তৈরি করা। ৫৪ কিলোমিটারের রিং রোড করা গেলে টহল আরও বাড়ানো যেত। এমনকি মোটরসাইকেলে করে টহল দেওয়া গেলেও নাফ নদী থেকে ইয়াবার চালান ভেতরে আনা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমরা যখন টহল দিই, তখন ইয়াবা কারবারিরা মিয়ানমারে খবর পাঠিয়ে দেয়, এই অবৈধ ব্যবসা অনেক লাভজনক হওয়ায় তাদের বহু মানুষ এ কাজে জড়িত।’

অভিযানের মধ্যেও টেকনাফে আসছে ইয়াবা
গত ১৬ মে থেকে ৯ জুন পর্যন্ত ২৫ দিনে বিজিবির বিভিন্ন অভিযানে টেকনাফ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৭০৪টি ইয়াবা বড়ি। এসব ঘটনায় আটক করা হয়েছে ১১ জনকে। একই সময়ে পুলিশের অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৫০টি ইয়াবা। মামলা হয়েছে ১১টি। আটক করা হয়েছে ১২ জনকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর উদ্ধার করেছে ৪২ হাজার ২৭০টি ইয়াবা। গ্রেপ্তার করেছে ৫ জনকে। কোস্টগার্ড উদ্ধার করেছে ৫০ হাজার ইয়াবা। এ ছাড়া র‍্যাবের অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৯৯৩টি ইয়াবা। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৫ জনকে। সব মিলিয়ে অভিযানের মধ্যেই প্রায় সাড়ে ৮ লাখ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট বাহিনী সূত্রে পাওয়া।
এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ মে পর্যন্ত বিজিবি ৬৬ লাখ ৫ হাজার ৯৮০টি ইয়াবা, পুলিশ ১৬ লাখ ৩৫ হাজার ৩০, কোস্টগার্ড ৬২ লাখ ৩২ হাজার ২৫৬, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ৭৮ হাজার ৬৪ এবং র‍্যাব ৪ লাখ ১৬ হাজার ৫৫৭টি ইয়াবা উদ্ধার করে। সব মিলিয়ে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৬৭ হাজার ৮৮৭ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

নাফ নদীতে টহল পরিস্থিতি
ইয়াবাসহ মাদক পাচার, চোরাচালান এবং রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদীতে টহলের ব্যবস্থা রয়েছে কোস্টগার্ড ও বিজিবির। তবে ৫৮ কিলোমিটার দীর্ঘ জলসীমানার কঠোর নজরদারি ও টহল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে জনবল দরকার, তা টেকনাফের কোনো সংস্থারই নেই। ফলে জলসীমার বেশির ভাগ অংশই অরক্ষিত থাকে।
কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের কমান্ডার লে. ফয়জুল ইসলাম মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, নাফ নদীতে দুই ঘণ্টা পরপর কোস্টগার্ডের বেশ কয়েকটি টহল দল অভিযানে যায়। প্রতিটি টহল দলে ৫-৬ জন সদস্য থাকেন। জনবল রয়েছে ২৭ জন।
অন্যদিকে নাফ নদীর ৫৪ কিলোমিটার এলাকাসহ টেকনাফের বিভিন্ন সড়কে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বিজিবির ৫৬টি দল নিয়মিত টহল দিচ্ছে। এ ছাড়া আরও ১৩টি দল নাফ নদীতে বিশেষ টহল দেয়।
জলসীমা পেরিয়ে টেকনাফের স্থলভাগে ইয়াবা ঢোকার পর তা প্রতিরোধের দায়িত্ব প্রধানত পুলিশের। এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি রনজিত কুমার বড়ুয়া বলেন, থানার জনবলসংখ্যা ৭৫। নাফ নদী ও সাগরে অভিযান চালানোর মতো কোনো নৌযান পুলিশের নেই। এরপরও বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ইয়াবাসহ লোকজন আটক করছে।

দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ অরক্ষিত
কক্সবাজার সদর থেকে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। এই সড়কের ডান পাশে সমুদ্র ও বাঁ পাশে পাহাড়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নাফ নদীতে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি মেরিন ড্রাইভেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল বাড়ানো দরকার। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার পরপর দুদিন সমুদ্রের তীরঘেঁষা এই সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খুব বেশি উপস্থিতি চোখে পড়েনি।
সরেজমিনে মেরিন ড্রাইভে দেখা যায়, ৮০ কিলোমিটারের রাস্তায় পুলিশের দুটি ও বিজিবির চারটি চৌকি রয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র রেজুখাল এলাকায় বিজিবির চৌকিটি স্থায়ী। বাকি সব কটি চৌকি অস্থায়ী। সন্ধ্যা নামার পর গোটা মেরিন ড্রাইভ সড়ক অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এ সড়কে তখন মানুষের চলাচল কমে যায়।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নাফ নদী ও সীমান্তে কড়াকড়ি থাকলে সাগরপথ হয়ে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে ইয়াবা আসে। বিশাল সড়কের পাশে কোনো সৈকতে ইয়াবা বহনকারী নৌকা নোঙর করলে তা তল্লাশি করার মতো কেউ থাকে না। সাগর থেকে ইয়াবা এনে মেরিন ড্রাইভ পার হয়ে পাশের পাহাড়ে ঢুকে পড়লে ইয়াবা পাচারকারীরা সহজেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আড়ালে চলে যেতে পারে।