পাহাড়ধস রোধে কমিটির সুপারিশ অনেক, বাস্তবায়ন কম

পাহাড়ধসে নিহত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করছে পুলিশ। রাঙামাটির নানিয়ারচরে। গতকাল বেলা একটায়।  ছবি: প্রথম আলো
পাহাড়ধসে নিহত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করছে পুলিশ। রাঙামাটির নানিয়ারচরে। গতকাল বেলা একটায়। ছবি: প্রথম আলো

পাঁচ থেকে সাত বছর পাহাড় থেকে সব ধরনের কাঠ সংগ্রহ বন্ধ করতে হবে—সুপারিশ এমনই ছিল। গত বছর পাহাড়ধসের কারণ অনুসন্ধান এবং করণীয় নিয়ে গঠিত কমিটির একগুচ্ছ সুপারিশের মধ্যে এটি ছিল একটি।

গত বছর ১২ থেকে ১৩ জুন ছয় জেলায় ভূমিধসে ১৬৮ জন মারা যান। এর মধ্যে ১৩ জুন রাঙামাটিতেই নিহত হন ১২০ জন। এরপর সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় একটি উচ্চপদস্থ কমিটি করে। তারা গত বছরের ডিসেম্বরে প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু গাছ কাটা বন্ধে বা কাঠ সংগ্রহে যে সুপারিশ করেছিল, তার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।

এদিকে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাঙামাটিতে ফের বড় আকারের পাহাড়ধস হয়েছে। সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার ভোরে জেলার নানিয়ারচর উপজেলায় পাহাড়ধসে ১১ জনের প্রাণ গেছে।

পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের কাঠ ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের ব্যবসায় চলছেই। পাহাড় থেকে তাঁরা গাছ সংগ্রহ করছেন। খাগড়াছড়ি কাঠ ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘পাহাড়ে গাছ সংগ্রহে সরকারি কোনো নির্দেশের কথা তো শুনিনি।’

বনের দায়িত্ব বন বিভাগের। বন বিভাগের রাঙামাটি অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মো. ছানাউল্যা পাটোয়ারী সরকারি কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো সম্পর্কে জানেন। তবে তাঁর কথা, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনের দুই-তৃতীয়াংশ অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চল। এর রক্ষণাবেক্ষণ করে জেলা প্রশাসন। সেখানে গাছ কাটা রোধ করাটা প্রশাসনের বিষয়।

পাহাড়ে গাছ কাটা বন্ধে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. রাশেদুল ইসলাম বলছিলেন, ‘কমিটি (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কমিটি) যে সুপারিশ করেছে, তা তো সুপারিশ। আইন নয়। গাছ কাটা বন্ধে আগে তো আইন করতে হবে। তবেই তা বাস্তবায়ন করার প্রশ্ন আসবে।’ রাশেদুল ইসলাম বলেন, আইন করা তো নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এটা সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও নীতিনির্ধারকেরাই ঠিক করবেন।

শুধু গাছ কাটা নয়, পাহাড়ধস বন্ধে প্রকৃতি উপযোগী ব্যাপকভিত্তিক বনায়নেরও সুপারিশ করেছিল সরকারি কমিটি। তবে সিএফ ছানাউল্যা পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, গাছ কাটা বন্ধে তাঁদের মতামত তাঁরা মন্ত্রণালয়কে দিয়েছেন। গাছ কাটা বন্ধের পর বিকল্প কর্মসংস্থানে কী হবে, তা নিয়েও তাঁদের প্রস্তাব ছিল। তিনি বলেন, ‘পাহাড়ে বনায়নের জন্য পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছিল। তবে বিষয়টি আর এগোয়নি।’

পাহাড়ধসের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি করে গত বছরের জুন মাসেই। এর প্রথম সভা হয় ৪ জুলাই। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা এর নেতৃত্ব দেন। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে এই কমিটি প্রতিবেদন দেয়। তবে সত্যব্রত সাহা বলেন, ‘এই প্রতিবেদন বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়ে যায়।’

প্রতিবেদন নিয়ে এই কমিটির সভা হওয়ার কথা ছিল গত ১০ জুন। তা হয়নি। ঈদের পরে হবে বলে জানান সত্যব্রত সাহা।

গত বছরের ১৩ জুন রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে ১২০ জন নিহত হন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
গত বছরের ১৩ জুন রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে ১২০ জন নিহত হন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

গত বছর ভূমিধসে শুধু রাঙামাটি শহরেই নিহত হন ৭৩ জন, জেলার কাউখালী উপজেলায় ২১ এবং কাপ্তাইয়ে ১৮ জন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে ভূমিধসে এক দিনে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। যেসব এলাকায় পাহাড়ধস হয়েছিল, এর বেশির ভাগই নতুন তৈরি হওয়া বসতি এবং অপরিকল্পিত জনবসতি। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ‘ভূমি দখল ও অবৈধ বাসস্থান’ নির্মাণকে ধসের অন্যতম কারণ বলেও চিহ্নিত করে। পাহাড়ে এসব বসতি গড়ে উঠলেও স্থানীয় প্রশাসন তা বন্ধে তেমন কোনো তৎপরতা দেখায়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে করা সুপারিশগুলোর মধ্যে পাহাড়ধস রোধ করতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়কে চিহ্নিত করার সুপারিশ করা হয়। এর জন্য গবেষক ও বিজ্ঞানীদের দিয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক ভূতাত্ত্বিক জরিপের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করা হয়। এভাবে পাহাড়ের শ্রেণি নির্ণয় করে সেখান থেকে বসতি তুলে দেওয়ার সুপারিশ করে। এসব এলাকায় যেন দ্রুত ভূমিধসের আগাম বার্তা পৌঁছাতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং স্থাপনা তৈরিরও সুপারিশ করা হয়। শুধু ঝুঁকির মানচিত্র করলে ঝুঁকি প্রশমন করাটা সহজ হয়ে যায় বলেও এখানে মন্তব্য করা হয়।

ভূতাত্ত্বিক জরিপের কাজগুলো করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক রেশাদ মহম্মদ একরাম আলী বলেন, এ ধরনের জরিপের কোনো আলাদা প্রস্তাব তাঁদের কাছে আসেনি। তিনি জানান, ভূমিধসের আগাম বার্তা জানানোর জন্য টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তিন পার্বত্য জেলায় এটা করা হয়নি।

রেশাদ মহম্মদ একরাম আলী বলেন, তিন পার্বত্য জেলার জন্য ভূমিধসের আগাম বার্তা জানানোর ব্যবস্থা এবং ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় নির্দিষ্ট করতে জরিপের একটি প্রকল্প বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

পাহাড়ধসের পর তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে একাধিক কর্মশালা হয়। সচেতনতামূলক সভাও হয়। এরপর তিন পার্বত্য জেলায় বেশি পরিমাণ বৃষ্টি হলে শহর বা শহরতলির ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে এনে বিভিন্ন স্কুলে অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে বেশ কয়েকবার। তিন জেলায় রেড ক্রিসেন্টের কর্মীদের দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কমিটির প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ ছিল।

দুই দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল পার্বত্য তিন জেলায়। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে, বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর ১৫টি স্কুলে লোকজনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
এবার যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোও কিন্তু আগে চোখে পড়েনি।

গত বছর পাহাড়ের বিপর্যয়ের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতির প্রশ্নটি আলোচিত হয়। দিনের পর দিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মানুষ বসবাস করলেও প্রশাসন তা নিয়ে ছিল উদাসীন। সমতল বাংলাদেশের মধ্যে ভিন্ন এক ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের এলাকার জন্য ভিন্ন কোনো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কৌশল ছিল না। পাহাড় ধসের ক্ষয়ক্ষতির কারণ নিয়ে সরকারি প্রতিবেদনে বলাও হয়, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা রয়েছে।’

সমন্বয়হীনতার সমস্যা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যেও রয়েছে। পাহাড় ধসের বেদনাদায়ক ঘটনার পরও মন্ত্রণালয়গুলো একত্র হয়ে তাদের দায়িত্বগুলো পালন করেনি। একে অপরকে দোষারোপ করছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশে আমাদের ওপর যেসব দায়িত্ব ছিল, তা আমরা বেশির ভাগ করেছি। তবে সব মন্ত্রণালয় হয়তো সঠিকভাবে করেনি।’

ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় নিরূপণ, বন থেকে গাছ আহরণ বন্ধ, নতুন জনবসতি না গড়ে তোলার মতো স্বল্প মেয়াদে করা যায়, এমন কাজ এখনো কেন করা হলো না? রিয়াজ আহমেদ বলেন, এসব বিষয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং বলেন, ‘আমাদের কাছে একটি প্রতিবেদনই শুধু দেওয়া হয়েছে। তবে একে নিয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক ও সমন্বয় করে কাজ করার কোনো উদ্যোগ দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে আমরা পাইনি।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া অবশ্য প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ীই সব চলছে। সমন্বয়েরও সমস্যা নেই।