বদরগঞ্জে ভালো রাস্তা কেটেছেঁটে কাবিখা প্রকল্প বাস্তবায়ন

কাবিখা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে রাস্তার ধারের ঘাস-মাটিসহ তুলে ফেলার পর পুনরায় তা চাপা দেওয়া হচ্ছে। রাধানগর ইউনিয়ন, ওয়ার্ড নম্বর ৪, বদরগঞ্জ, রংপুর। ১৪ জুন। ছবি: প্রথম আলো
কাবিখা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে রাস্তার ধারের ঘাস-মাটিসহ তুলে ফেলার পর পুনরায় তা চাপা দেওয়া হচ্ছে। রাধানগর ইউনিয়ন, ওয়ার্ড নম্বর ৪, বদরগঞ্জ, রংপুর। ১৪ জুন। ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের বদরগঞ্জে একটি ভালো কাঁচা রাস্তা কেটেছেঁটে কাজের বিনিয়মের খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্প বাস্তবায়ন করার অভিযোগ উঠেছে। এতে এলাকার সাধারণ মানুষ ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁরা কাবিখা প্রকল্পের অর্থ খেয়েদেয়ে সাবাড় করার অভিযোগও তুলেছেন। তবে ওই কাবিখা প্রকল্পের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। প্রকল্পের নাম ‘বুদুরডাঙ্গা থেকে ফেডারেশন পাড়া পর্যন্ত ৬০০ মিটারে মাটি ভরাট’। এ জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সাড়ে ছয় মেট্রিক টন চাল। এর সরকারি মূল্য ২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে সাড়ে তিন মেট্রিক টন চাল প্রকল্প চেয়ারম্যান তুলে নিয়েছেন। প্রকল্পটির চেয়ারম্যান হচ্ছেন ওই ওয়ার্ডের সদস্য সাইদুল হক।

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, দুজন শ্রমিক ভালো কাঁচা রাস্তাটির ওপরের মাটি কোদাল দিয়ে আলগা করছেন এবং রাস্তার দুধারের ঘাস মাটিসহ ছিলে ফেলছেন। সেই তুলে ফেলা ঘাস পুনরায় রাস্তার ধারে বিভিন্ন স্থানে চাপা দিচ্ছেন। এলাকার লোকজন বলেন, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে রাস্তাটিতে প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে, তা কর্তৃপক্ষকে দেখানো। এখন পর্যন্ত রাস্তাটির প্রায় ৩০০ মিটার খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে।

ওই ভালো রাস্তা কাটাছাঁটার ছবি ক্যামেরাবন্দী করতে গেলে প্রকল্প চেয়ারম্যানের নিযুক্ত একজন শ্রমিক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘স্যার, কান্টির (রাস্তার কিনারের) ঘাস তুলে রাস্তার সৌন্দর্য আনছি।’ রাস্তার বুক কোদাল দিয়ে আলগা করা প্রসঙ্গে বলেন, ‘উঁচা-নিচা সমান করছি।’

কাবিখা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে এভাবে ভালো রাস্তার মাটি খুঁড়ে আলগা করা হচ্ছে। রাস্তার ধারের ঘাস-মাটিসহ ছিলে ফেলা হচ্ছে। রাধানগর ইউনিয়ন, ওয়ার্ড নম্বর ৪, বদরগঞ্জ, রংপুর। ১৪ জুন। ছবি: প্রথম আলো
কাবিখা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে এভাবে ভালো রাস্তার মাটি খুঁড়ে আলগা করা হচ্ছে। রাস্তার ধারের ঘাস-মাটিসহ ছিলে ফেলা হচ্ছে। রাধানগর ইউনিয়ন, ওয়ার্ড নম্বর ৪, বদরগঞ্জ, রংপুর। ১৪ জুন। ছবি: প্রথম আলো

প্রকল্পের আরেক শ্রমিক রবিউল ইসলাম (৩৫) বলেন, ‘হামার দোষ নাই স্যার। মানুষ ভালো রাস্তা খোঁড়া দেখি হামাক গাইলেওচে (গালাগাল করছে)। হামার করার কী আছে? কাম না করলে তো মেম্বার হামাক টাকা দিবার নেয়। মেম্বার যেংকা করি কইচে হামরা সেঙ্কা করি মাটি কাটোচি।’

ওই দুই শ্রমিক বলেন, তাঁরা প্রতিদিন প্রকল্পের কাজ করে মজুরি হিসেবে পান ৩০০ টাকা। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত তাঁরা কাজ করেন। বিধি অনুযায়ী, কাঁচা রাস্তায় মাটি ভরাট করার জন্য শ্রমিকদের প্রকল্পের চাল দেওয়ার কথা।

পাইকাড়পাড়া গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘রাস্তাটার কোনোটে ভাঙা নাই, ভালো রাস্তা, খুব শক্ত। রাস্তার দুই ধারের সউগ (সব) ঘাস মাটিসহ তুলি ফেলাওচে। শক্ত মাটি কোদাল দিয়া খুঁড়িয়া আলদা করিয়া ভালো রাস্তাটা খারাপ বানাওচে। পানি হইলে রাস্তাটা এখন ভাঙি চুরি যাইবে। কাদো হইবে। এ্যালা হাঁটতেও সমস্যা হওচে। এইগলা দেখার কী কাঁয়ো নাই।’

ওই গ্রামের গৃহবধূ রাবেয়া বেগম বলেন, ‘মোর জেবোনে দ্যাখো নাই সরকার ভালো রাস্তা এইভাবে খোঁড়ে। মেম্বারোক কইনো ভালো রাস্তা খোঁড়োছেন ক্যান? মেম্বার কইচে “রাস্তা খোঁড়ার জন্যে সরকার টাকা দেছে। তোমার হামার করার কী আছে।”

ভ্যানচালক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘বাহে মুই এত দিন দেখছু সরকার মেম্বারের ঘোরোক টাকা দেয় ভাঙা রাস্তা ভালো করার জন্য। কিন্তু এখন দ্যাখোচো ভালো রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির জন্যও সরকার টাকা দেয়। সরকারের কী মাথা খারাপ হইচে? এইটা কি ডিজিটাল দ্যাশ! ভালো রাস্তা খুঁড়িয়া মাটি তুলি আলদা করি দেওয়াতে এ্যালা ইশকা ভ্যান নিয়া যাইতেও কষ্ট হওচে।’

এ বিষয়ে প্রকল্পের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য সাইদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাই এখন বর্ষার সময় রাস্তার চতুর পাশে পানি। কোথাও মাটি পাওয়া যাচ্ছে না। ৩০ জুনের মধ্যে পিআইওকে কাজ দেখাতে হবে। না হলে চালের টন ছাড় দিবে না। তাই আপাতত রাস্তার মাটি ঢলাঢলি করে দিচ্ছি।’ রাস্তার শক্ত ধারের ঘাস মাটিসহ তুলে ফেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাটিসহ ঘাস না তুললে তো নতুন মাটি বসবে না।’ একপর্যায়ে ওই ইউপি সদস্য বলেন, ‘ভাই, মেম্বারদের কী আছে। দু-একটি কাজ পাই, তাতেও বিভিন্ন জায়গায় ভাগ দিতে হয়।’

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) বাবুল চন্দ্র রায় বলেন, ‘ওই রাস্তায় মাটি ভরাট করার জন্য কাবিখা প্রকল্পের (সাধারণ) আওতায় সাড়ে ছয় মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ভালো রাস্তার দুই পাশের ঘাস তোলা হলে কিংবা রাস্তা খুঁড়ে আলগা করার অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রকল্প চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাশেদুল হক বলেন, ‘বিষয়টি আমি এখনই দেখছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রকল্পের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’