অস্ত্রোপচার নয়, স্বাভাবিকভাবেই সন্তানের জন্ম

রাজধানীর মিরপুরে মিডওয়াইফারি লিড কেয়ার সেন্টারে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে দেখভাল করছেন মিডওয়াইফ উম্মে সালমা। ছবি: মানসুরা হোসাইন
রাজধানীর মিরপুরে মিডওয়াইফারি লিড কেয়ার সেন্টারে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে দেখভাল করছেন মিডওয়াইফ উম্মে সালমা। ছবি: মানসুরা হোসাইন

তিনজন অন্তঃসত্ত্বা নারী সন্তান প্রসবের অপেক্ষায়। সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা একজনকে বড় বলের ওপর বসিয়ে ব্যায়াম করাচ্ছেন, আবার গিয়ে আরেকজনের রক্তচাপ মাপছেন। এক হবু মায়ের কাছে গিয়ে একজন বললেন, ‘আপনার মুখটা শুকনা লাগছে, একটু বেশি করে পানি খান।’
সন্তান প্রসবের ব্যথায় কাতর ফারজানা আক্তারের প্রেশার মাপতে মাপতে মিডওয়াইফ উম্মে কুলসুম বললেন, ‘আপনার পেটের বাচ্চা ভালো আছে। আপনি আমাদের সঙ্গেই থাকেন, অপেক্ষা করেন। যতক্ষণ না আপনার স্বাভাবিক প্রসব হবে, আমরা আছি আপনার পাশে।’ উম্মে কুলসুমের মুখে আশার বাণী শুনে ফারজানার মুখে হাসি দেখা দেয়। কুলসুম দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘যে মায়ের এক বাচ্চা আমার হাতে হবে, ওই মা দ্বিতীয়বার মা হলে আমাকেই খুঁজবে।’
গত মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বরে দারুসসালাম থানার কাছে (১৭/১ আনন্দনগর) মিডওয়াইফারি লিড কেয়ার সেন্টারে গিয়ে দেখা যায় এ চিত্র। এ সেন্টারে উম্মে কুলসুমের মতো আরও তিনজন মিডওয়াইফ ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছেন। মায়েদের স্বাভাবিক প্রসব হতে যত সময়ই লাগুক, সেই মায়েদের পাশেই থাকেন তাঁরা। এই সেন্টারের বিশেষত্ব হলো, উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও মায়েদের প্রসব করাচ্ছেন দক্ষ মিডওয়াইফরা। মিডওয়াইফদের সহায়তা করার জন্য আছেন প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী। কোনো মায়ের শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক প্রসব না হলে বা কোনো বিপদচিহ্ন দেখা দিলেও চিন্তার কিছু নেই, এই মিডওয়াইফরা মায়েদের নির্দিষ্ট হাসপাতালে রেফার করে দেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধীনে মিডওয়াইফারি এডুকেশন প্রোগ্রাম এবং বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক এ সেন্টার পরিচালনা করছে। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত মিডওয়াইফরা মিডওয়াইফারি এডুকেশন প্রোগ্রাম অধীনে তিন বছরের ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্স করেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে সেন্টারটি যাত্রা শুরু করেছে। কমিউনিটির ভেতরে থেকে কমিউনিটির মায়েদের প্রসব-পূর্ববর্তী, স্বাভাবিক প্রসব, প্রসব-পরবর্তী সেবাসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়ার জন্য এটি পরিচালিত হচ্ছে।

সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জানালেন, ঈদের ছুটির সময় যে মায়েদের সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাঁরা আগে থেকেই এসে কথা বলে গেছেন যে তাঁরা এখানেই আসবেন। সেই মায়েদের বলে দেওয়া হয়েছে, কোনো চিন্তা নেই, ঈদের ছুটি থাকলেও কেন্দ্রের মিডওয়াইফরা ২৪ ঘণ্টাই সেবা দেবেন মায়েদের।

সেন্টারে গিয়ে দেখা গেল, মায়েদের স্বাভাবিক প্রসবের জন্য মিডওয়াইফারি চেয়ার রয়েছে। এ ছাড়া শুয়ে, বসে না দাঁড়িয়ে, মা কোন পদ্ধতিতে সন্তান প্রসব করতে চান, তার ব্যবস্থা করা আছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আসা গর্ভবতী মায়েদের শেখানো হচ্ছে বিভিন্ন শারীরিক কসরত। এ সেন্টারে শুধু দুই দিন চিকিৎসক বসেন আল্ট্রাসনোগ্রামসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে একজন মিডওয়াইফ কমিউনিটিতে যান মায়েদের খোঁজখবর নিতে।

কথা হলো সন্তান প্রসবের জন্য আসা ফারজানা আক্তারের সঙ্গে। বিছানায় শুয়ে বা মিডওয়াইফারি চেয়ারে বসে যেভাবে ভালো লাগছিল, সেভাবেই তা করতে পারছিলেন ফারজানা। বাড়ি থেকে আনা খাবার মুখে তুলে দিচ্ছিলেন ফারজানার মা।

জানা গেল এখানে যে মায়েরা সন্তান প্রসবের জন্য আসেন, তাঁরা ঘরোয়া পরিবেশেই থাকার সুযোগ পান। স্বামী, মা বা যেকোনো একজন স্বজন সঙ্গে থাকতে পারেন।

রাজধানীর মিরপুরে মিডওয়াইফারি লিড কেয়ার সেন্টারে সন্তান প্রসবের জন্য আসা ফারজানা আক্তারকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন তাঁর মা। ছবি: মানসুরা হোসাইন
রাজধানীর মিরপুরে মিডওয়াইফারি লিড কেয়ার সেন্টারে সন্তান প্রসবের জন্য আসা ফারজানা আক্তারকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন তাঁর মা। ছবি: মানসুরা হোসাইন

হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত সেন্টারটিতে ১৯৬ জন মায়ের স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। এ সময়ে কোনো মা মারা যাননি। বিভিন্ন জটিলতা থাকায় ৩৯ জন মাকে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এখানে প্রসবের জন্য আসা মায়ের প্রসব কতটুকু অগ্রসর হলো, তার জন্য পার্টোগ্রাফ ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য ওষুধসহ মোট খরচ ২ হাজার ৪০০ টাকার বেশি লাগে না সেন্টারটিতে।

সেন্টারে মিডওয়াইফদের সুপারভাইজার এবং কারিগরি সহায়তা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছেন সেন্ড্রা রুমি মধু। তিনি বলেন, প্রসবের পরই সন্তানের যত্ন, সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো, কোনো মা পরিবার পরিকল্পনার কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করতে চাইলে তার ব্যবস্থা করাসহ সব দায়িত্ব পালন করছেন মিডওয়াইফরা। আর মায়েদের ব্যথা কমানোর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহারে মায়েরাও খুশি থাকেন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধীনে মিডওয়াইফারি এডুকেশন প্রোগ্রামের প্রধান চিকিৎসক সেলিনা আমিন প্রথম আলোকে বলেন, উন্নত বিশ্বে স্বাভাবিক প্রসবের জন্য কেউ চিকিৎসকের পেছনে দৌড়ান না, সবাই যান মিডওয়াইফের কাছে। মিডওয়াইফারি লিড কেয়ার সেন্টারে শুধু মিডওয়াইফদের তত্ত্বাবধানে মায়েদের স্বাভাবিক প্রসব হচ্ছে। অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব করতেই হবে বা প্রসবের সময় চিকিৎসক থাকতেই হবে, আগে অস্ত্রোপচারে সন্তান হয়ে থাকলে পরের সন্তানের বেলায় অস্ত্রোপচার লাগবেই—এ ধরনের ধারণাও পাল্টানোর দায়িত্ব পালন করছেন মিডওয়াইফরা।

সেলিনা আমিন জানালেন, মিরপুরের সেন্টারটি পাইলট হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে সিলেটের গ্রামীণ পরিবেশে এ ধরনের মিডওয়াইফারি লিড কেয়ার সেন্টার চালুর প্রক্রিয়া চলছে।